কথায় বলে, কারও বাড়ি বেড়াতে গেলে খালি হাতে যেতে নেই। মা দুর্গাও কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন সে কথা। বছরে একবার যখন তিনি বেড়াতে আসেন বাপের বাড়িতে, তাঁর দশ হাত ভরে থাকে দশরকম অস্ত্র। কিন্তু বলুন তো, প্রতি বছর দেখলেও, দশটি অস্ত্রের নাম কি আমাদের মনে থাকে সবসময়? আর সেইসব অস্ত্রশস্ত্রের পিছনে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলোও আরেকবার শুনে নিলে মন্দ কী!
অসুরদের অত্যাচারে যখন দেবতাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলেন তাঁরা। তখন দেবতাদের মিলিত তেজপুঞ্জ থেকে জন্ম নিলেন দেবী দুর্গা। অসুর নিধনের জন্যই তাঁর আবির্ভাব। সুতরাং সবার আগে প্রয়োজন অস্ত্র। সদ্যোজাতা দেবীকে নিজেদের ভাঁড়ার থেকে অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে দিলেন দেবতারাই। দেবীর দশ হাতে উঠল দশ প্রহরণ। কী ছিল সেসব অস্ত্র?
আরও শুনুন: রামায়ণ ছাড়া মহাভারতেও ছিলেন দেবী দুর্গা, কারা পূজা করেছিলেন তাঁর?
সে কথা বলার আগে এ কথা বলে নেওয়া যাক, দেবীর দশ হাতেই কিন্তু প্রথাগত অস্ত্র থাকে না। থাকে অন্যান্য কিছু সরঞ্জামও। তবে দেহের শক্তি না বাড়ালেও মানসিক শক্তি বাড়ানোর উপকরণ হিসেবে দেখা যেতেই পারে তাদের।
দুর্গাপ্রতিমার দিকে তাকালে প্রথমেই কোন অস্ত্রের দিকে চোখ পড়ে? বলাই বাহুল্য, ত্রিশূল। যা দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন দেবী। এই ত্রিশূল তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং শূলপাণি শিব। ত্রিশূলের তিনটি ‘শূল’ ত্রিবস্তুর ইঙ্গিতবাহী। কখনও তা সত্ত্ব, রজ ও তম— এই ত্রিগুণের প্রতীক হিসেবে বর্ণিত। কখনও আবার সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের প্রতীক রূপে দেখা হয় এই তিনটি ‘শূল’-কে। কোনও কোনও সময় দেবীর হাতে যে সাপ দেখা যায়, সেটিও শিব-ই তাঁকে দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। সাধনার ক্ষেত্রে সর্প হল কুলকুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক। সাধক মানসিক শক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগরিত করতে পারেন বলে মনে করা হয়।
আরও শুনুন: বৈদিক যুগ থেকে থিম পুজো… কীভাবে বদলেছে দুর্গাপ্রতিমার রূপ?
দুর্গাকে বিষ্ণু দেন তাঁর হাতের সুদর্শন চক্র। সুদর্শনের গায়ে ১০৮টি ধারালো ফলা রয়েছে। শাস্ত্রমতে, সুদর্শন চক্রাকার ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক এবং দেবীশক্তি তার কেন্দ্রস্থল। দেবীকে যমরাজ দিয়েছিলেন কালদণ্ড বা গদা৷ যা মোহকে চূর্ণ করে।
আবার তিনিই দেবীকে খড়্গ প্রদান করেছিলেন বলেও জানায় পুরাণ। কোথাও কোথাও এই অস্ত্রকে তরবারি হিসেবেও দেখা যায়। এই অস্ত্র মৃত্যুর ইঙ্গিতবাহী, আবার ন্যায়বিচারেরও প্রতীক। বিশ্বকর্মা দেবীকে দিয়েছিলেন কুঠার-সহ আরও বিভিন্ন অস্ত্র। কুঠার একাধারে নির্মাণ ও ধ্বংসের প্রতীক।
দুর্গাকে ধনুর্বাণ দান করেন পবন। গতির প্রতীক পবনদেবের অস্ত্রেও রয়েছে গতিশক্তিরই প্রকাশ। আবার অগ্নিদেব দুর্গার হাতে অগ্নি তুলে দিয়েছিলেন। অগ্নি সকল অশুভ, ক্লেদকে দহন করে শুদ্ধ করে। জ্ঞানেরও প্রতীক অগ্নি। আবার অগ্নি একদিক থেকে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিভূও বটে। মানবসভ্যতার সূত্রপাত হয়েছিল আগুনের আশীর্বাদে, সে কথা বলাই বাহুল্য। প্রকৃতি উপাসনার সঙ্গে যোগ রয়েছে দেবীর হাতের অন্য অস্ত্রেরও। যেমন, দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া বজ্র।
জলদেবতা বরুণ দুর্গাকে প্রদান করেছিলেন শঙ্খ। যে কোনও মাঙ্গলিক কাজ থেকে শুরু করে যুদ্ধারম্ভ— সব কাজেই ব্যবহৃত হয় শঙ্খ। জীবজগতে প্রাণের সূচনা, এমন প্রতীক হিসেবেও দেখা হয় একে। আর ব্রহ্মার দেওয়া পদ্ম আধ্যাত্মিক জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। তা নির্মল, সুন্দর, চৈতন্যের প্রতীক। আবার মতান্তরে ব্রহ্মা নিজের কমণ্ডলু দান করেন দেবীকে। এই পাত্রে ধৃত জল সৃষ্টির প্রতীক।
আসলে, দেবী দুর্গার হাতের অস্ত্রগুলি রূপক মাত্র। মনের অন্ধকার, অসংযমকে দূর করে এই দশ প্রহরণ। এগিয়ে দেয় আলোর উদ্দেশে, ভালর দিকে।