তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো করেন। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। যা একেবার পছন্দ ছিল না হুতোমের, নিন্দা করেছিলেন তাঁর রচিত নকশায়। আসলে বৈদিক যুগ থেকে আজকের মাতৃরূপে পৌঁছতে লম্বা ইতিহাস ডিঙোতে হয়েছে বাংলার প্রতিমাশিল্পকে। কেমন ছিল সেই ধারা বিবর্তন?
থিম পুজোর যুগে মণ্ডপসজ্জার আকর্ষণই সবচাইতে বেশি। তবু, প্রতিমা দর্শনও একটা বড় ব্যাপার। কথায় বলে ‘ঠাকুর দেখা’। তো সেই ঠাকুরের অভিনবত্বও এখন একটা দেখবার জিনিস। যেমন, করোনাকালে ত্রিশূল হয়ে গিয়েছে ভ্যাকসিন দেওয়ার ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ, অসুর হয়েছে করোনাসুর। এমন কত কী! অথচ, ভাবতে অবাক লাগে, দুর্গাপুজো বা অন্য মাতৃপুজো থাকলেও প্রাচীনকালে প্রতিমা জিনিসটাই ভূভারতে ছিল না।
বৈদিক যুগে মূর্তিপুজোর রেওয়াজ ছিল না একেবারেই। কেবল যজ্ঞের শেষে পূর্ণাহূতি দেওয়ার পর ধ্যান করার নিয়ম ছিল। বৈদিক যুগে দেব-দেবীদের মন্দিরও ছিল না। শাস্ত্র মতে, দুর্গা, কালী, তারা, কমলা, জগদ্ধাত্রী সকলেই ছিলেন বীজমন্ত্রগত ধ্যানের দেবতা। তারা একই মহামায়ার বিভিন্ন রূপ। তন্ত্রে স্পষ্ট করে বলা আছে, মা হলেন শতরূপা। জগতে যত সাধক, মায়ের রূপও তত রকমের। এই কারণেই ভারতবর্ষের কোনও প্রাচীন মন্দিরে দেবতার রূপবিগ্রহ মেলে না। সেখানে আছে প্রস্তরখণ্ড। যেমন, কাশীর অন্নপূর্ণা আসলে একখণ্ড পাথর মাত্র। সেই পাথরের মাথায় বসানো আছে সোনার মুখ। আর আছে দুই পাশে দুইখানা সোনার হাত। কালীঘাটের মা কালীর দিকে তাকালেও এই রূপই প্রত্যক্ষ করি আমরা। কিন্তু, পূর্ণাঙ্গ মূর্তিপুজো কীভাবে শুরু হল তবে?
আরও শুনুন: দুর্গাপুজো করতে সাহেবদের সঙ্গে মামলা লড়েছিলেন রানি রাসমণি
মূর্তি পূজার প্রবর্তক বৌদ্ধরা। প্রতিমাশিল্পের সূচনাও হয় ওই বৌদ্ধদের আমলেই। তবে আধুনিক যে প্রতিমাশিল্প, তার জন্ম কিন্তু মাত্র ৮০০ বছর আগে। নেপথ্য ছিলেন তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ। জানা যায়, তিনিই প্রথম মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন। এর পর ভাদুড়িয়ার মহারাজা জগৎনারায়ণ রায় ঘটা করে দুর্গাপুজো করেন। সেকালে পুজোর আয়োজনে নয় লক্ষ টংকা ব্যয় করেছিলেন। তবে কিনা তা ছিল বাসন্তী দুর্গাপুজো। পরবর্তীতে যে সময়টাকে শ্রীচৈতন্য সেবকদের অভ্যুদয়কাল বলা হয়, সেই সময় বাংলায় মাটির প্রতিমা গড়ে পুজোর প্রচলন হয়। ব্যাপক আকারে তা বিস্তারও লাভ করে।
এর পরবর্তী ধাপের কাহিনি অবশ্যি বেশিদিন আগের কথা না। সেটা হল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই দুর্গা প্রতিমায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে এই বিবর্তন ব্যাপক আকার ধারণ করে। এবারে কেবল প্রতিমাশিল্পেই নয়, পুজোর পুরো চেহারাটাই বদলাতে শুরু করে। নয়া বিবর্তনের হোতা ছিলেন বিত্তবান জমিদার, তালুকদাররা।
আরও শুনুন: সাড়ম্বরে দুর্গাপুজো করতেন বঙ্কিমচন্দ্র, অঢেল দানে হাসি ফুটত গরিবের মুখেও
প্রতিমাশিল্পের এই বদলকে কিন্তু অনেকেই পছন্দ করেননি। তাঁর উদাহরণ আছে কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা হুতোমপেঁচার নকশাতেও। ১৮৬২ সালে প্রকাশিত নকশায় হুতোম লেখেন, “বিলেত থেকে অর্ডার দিয়ে সাজ আনিয়ে প্রতিমা সাজানো হয়। মা দুর্গা মুকুটের পরিবর্তে বনেট পরেন, স্যান্ডউইচের শেতল খান, আর কলাবউ গঙ্গাজলের পরিবর্তে কাৎলী-করা গরম জলে স্নান করে থাকেন, শেষে সেই প্রসাদী গরম জলে কর্মকর্তাদের প্রাতরাশের টি ও কফি প্রস্তুত হয়।”
শুনে নিন বাকি অংশ।