শুধু উপাস্য হিসেবে নন। বাঙালির স্বাদেও জুড়েছে কৃষ্ণনাম। এক নয়, একাধিক খাবারে রয়েছে গোবিন্দর নাম। মিষ্টির পাল্লা একটু বেশি ভারি। তালিকায় অন্য খাবারও রয়েছে। কীভাবে রাধামাধবের নাম জুড়ল তাতে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
কৃষ্ণমোহন, কৃষ্ণচন্দ্র, কৃষ্ণকুমার… বাঙালির নামে কৃষ্ণের ছড়াছড়ি। শুধু নাম কেন। খাবারেও ব্যাপারটা প্রায় সমান। লোককথায় শ্রীকৃষ্ণের একশো আট নামের খোঁজ মেলে। সব নামের সঙ্গে খাবার জোড়েনি। মোটামুটি প্রচলিত গোবিন্দ, রাধামাধব কিংবা গোপালের নামেই পূর্ণ হয়েছে বাংলার রসভাণ্ড।
আরও শুনুন:
৫১ পীঠই বাঙালির সাধের পিঠের উৎপত্তিস্থল, মহাভারতেও আছে ১০৮ রকমের পিঠের উল্লেখ
মথুরায় জন্ম। গোকুলে বড় হওয়া। বৃন্দাবনে লীলাবিলাস। দ্বারকার রাজা। শ্রীকৃষ্ণের জীবনবৃত্তান্তে মোটামুটি এই কটা জায়গার বিশেষ উল্লেখ মেলে। পুরাণে কোথাও সেই অর্থে কৃষ্ণের সঙ্গে বাংলার যোগ দেখানো হয়নি। অথচ বাংলায় কৃষ্ণ আরাধনার চল সেই প্রাচীনকাল থেকেই। বিষ্ণুপুর, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার সহ এ রাজ্যের নানা প্রান্তে রয়েছে একাধিক কৃষ্ণ মন্দির। বেশিরভাগই পুরনো। এতটাই, যে বাংলার সংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে এইসব কৃষ্ণ মন্দিরের উল্লেখ করেন কেউ কেউ। এই সূত্র ধরেই উঠে আসে খাবারের কথা। সবেতেই দেবতা কৃষ্ণের যোগ নেই। তবে তাঁর নাম বর্তমান। গোকুলপিঠের কথাই ধরা যাক। ময়দা, খোয়া ক্ষীর, নারকেল দিয়ে তৈরি বিশেষ পিঠে। রসে ডোবানো, তাই মিষ্টত্ব নির্ভর করছে রস কতটা গাঢ়। কৃষ্ণের বেড়ে ওঠা যে গোকুলে, সেই গ্রামের নামেই এই পিঠে। একইভাবে গোপালভোগ। বর্ধমানের কিছু জায়গায় এই মিষ্টির চল রয়েছে। রসগোল্লার মতো ছানার মিষ্টি। তবে রসে ডোবানো নরম তুলতুলে নয়। বরং দানাদার গোত্রের, কিছুটা শক্ত। রস ভরপুর এতেও। রং খানিক বাদামী। অনেক দোকানে গোপালভোগের উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গুঁড়ো খোয়া ক্ষীর। তবে নাম ছাড়া এর সঙ্গে দেবতা গোপালের বিশেষ যোগ নেই। সম্পর্ক টানা যেতে পারে ভোগের সূত্রে। মানে, গোকুলপিঠে আর গোপালভোগ দুই মিষ্টিই কৃষ্ণের ভোগে দেওয়া যায়।
আরও শুনুন:
বাঙালির ভোজে পোলাও না থাকলেই নয়! কিন্তু তার জন্ম কি আদৌ ভারতে?
এবার আসা যাক, সেইসব খাবারের কথায় যার সঙ্গে দেবতা কৃষ্ণের যোগ রয়েছে। তালিকার শুরুতেই রাধাবল্লভী। মিষ্টি নয়, তবে রাধাবল্লভীর পুরে অনেকেই চিনি মেশান। স্বাদে সামান্য মিষ্টত্ব ধরা পরে। অন্তত এই মিষ্টি স্বাদের সূত্র ধরেই রাধাবল্লভীকে সাধারণ কচুরির থেকে আলাদা করা যায়। সংজ্ঞা হিসেবে বলতে হয়, পুর ভরা বড় আকারের লুচি। নরম, কিন্তু একটু মোটা। পুরপুরি ফুলবে না। এই মিষ্টিই নাকি ভোগ হিসেবে দেওয়া হত মুর্শিদাবাদের কান্দির বিখ্যাত রাধাবল্লভকে। সে উল্লেখ মেলে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রাধাবল্লভী সম্পর্কে একথা লিখেছিলেন। আবার এমনটাও শোনা যায়, এই রাধাবল্লভী বৃন্দাবনে গিয়ে শিখেছিলেন জিতেন্দ্রমোহন। কলকাতার বিখ্যাত পুঁটিরাম মিষ্টির দোকান তাঁর পিসেমশাই-এর। সেই দোকানে বৃন্দাবন থেকে শিখে আসা রাধাবল্লভী বিক্রি শুরু করেন জিতেন্দ্র। অল্পদিনে সেই বড় লুচির সুনাম ছড়ায়। যা এখনও তেমন ফিকে হয়নি। নেপথ্যে মাহাত্ম্য কার, রাধাবল্লভী নাকি রাধাবল্লভ কৃষ্ণের তা বলা কঠিন। বাঙালির রসনায় আরাম। সেই সুবাদেই পুঁটিরামে ভিড় জমে। গোপালকলা-র সঙ্গেও দেবতা কৃষ্ণের যোগ স্পষ্ট। নারকেল কোরার সঙ্গে ভিজিয়ে রাখা চাল ও বিভিন্ন ফল মিশিয়ে প্রস্তুত করা এই ভোগ-ই নাকি গোপালের সবথেকে প্রিয় ভোগ। শোনা যায়, কলকাতার বিখ্যাত ভীম নাগেও বৈকুণ্ঠভোগ নামে এক মিষ্টি পাওয়া যেত। এর সম্পর্কে সঠিক তথ্য মেলে না। মিষ্টির মতোই তার অবলুপ্তি ঘটেছে। নাম থেকে অনেকে আন্দাজ করেন কৃষ্ণের সঙ্গে এর বিশেষ যোগের বিষয়টি। লুচি, মিষ্টি, পিঠে সবই হল। তালিকায় রয়েছে চালও। গোবিন্দভোগ। নামের চাইতে গন্ধের সুবাদে অধিক পরিচিত এই চাল। ব্যবহার মূলত ঠাকুরের ভোগেই। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, গোবিন্দভোগ চালের চাষ শুরু গোবিন্দকে ভোগ নিবেদনের উদ্দেশ্যেই। নেপথ্যে বিশেষ এক গল্পও রয়েছে। শোনা যায়, গোবিন্দপুরের এক জঙ্গলে কৃষ্ণমন্দিরের হদিশ পান শেঠ পরিবার। হুগলির বসাকদের সঙ্গে মিলে তাঁরাই নদীর ধারে সুগন্ধী চালের চাষ শুরু করেন। সেই চালের ভোগ নিবেদন করা হত গোবিন্দকে। সেভাবেই সুগন্ধী চালের নাম হয় গোবিন্দভোগ। তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। ঠিক যেভাবে বাঙালি জীবনে কৃষ্ণের চিরন্তন উপস্থিতি, স্বাদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।