ভোজ বলতেই বাঙালি বোঝে পোলাও মাংস। পলান্ন থেকে নাম বদলে পোলাও হলেও, তার অপূর্ব স্বাদে কোনও বদল নেই। কিন্তু বাঙালি যতই পোলাও খেতে ভালো বাসুক না কেন, পোলাও কি আদৌ বাঙালি খাবার? এমনকি এ দেশেরও খাবার কি? আসুন, শুনেই নেওয়া যাক।
বাঙালি ভোজে পোলাও থাকবে না, এ যেন ভাবাই যায় না। শোনা যায়, ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে খোদ বিশ্বকবিকেই রেয়াত করেননি নবনীতা। পাতে লুচি পড়তে বেজায় চটে বলেছিলেন, এ কেমন নেমন্তন্ন, পোলাও নেই? খুদে অতিথির মান ভাঙাতে আসরে নামতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকেই। পোলাও-এর চটজলদি রেসিপি বাতলে দিয়েছিলেন তিনি। বাঙালির সাজানো ভোজে পোলাও যে কেমন অপরিহার্য, আর এই বিশেষ খাবারটির প্রতি বাঙালির টানও যে কতখানি, এ গল্প থেকে সে কথা কিন্তু স্পষ্ট। বাংলার পুরনো দিনের গল্পগাছা দেখুন, ভালো খাবারের কথা বলতেই পোলাও-এর সঙ্গে মাংস কিংবা কালিয়ার অনুপান মিলবে সেখানে। তা ছাড়া পোলাও-এর ভালো নাম পলান্ন, অর্থাৎ কিনা পলমিশ্রিত অন্ন। আর পল অর্থ মাংস। বুঝতেই পারছেন, আজকের দিনে যতই শুভদিনে নিরামিষ খাওয়ার নিদান দেওয়া হোক না কেন, সেকালে বাঙালির শুভদিন ভূরিভোজ ছাড়া সম্পূর্ণ হত না। আর সে ভূরিভোজও সম্পূর্ণ হত না আমিষের ভোজ ছাড়া। পূর্ববঙ্গগীতিকায় দেখা যাচ্ছে, সহচরদের আপ্যায়নের জন্য পোলাও কোর্মা তৈরি করাচ্ছেন এক জমিদার। আবার বাংলা ভাষার প্রথম দুটি রান্নার বই পাকরাজেশ্বর ও ব্যঞ্জনরত্নাকর-এ প্রায় ষাট রকমের পোলাও রান্নার রেসিপি মেলে। আমের পোলাও, লাউয়ের পোলাও থেকে তেঁতুলের পোলাও পর্যন্ত সেখানে বাদ যায়নি। উনিশ শতকের আরও এক রান্নার বই, শরৎচন্দ্র দাসের বিশুদ্ধ পাক-প্রণালী তো গোলাপফুলের পোলাও রাঁধার নির্দেশিকাও বাতলে দিয়েছে।
কিন্তু কথা হল, পোলাও যতই বাঙালির প্রিয় খাবার হোক না কেন, এ খাবার কি বাংলার? এমনকি ভারতেও এর জন্ম হয়েছিল কি?
আরও শুনুন:
বাঙালির বিরিয়ানিতে আলুর ঠাঁই হল কীভাবে?
পলান্ন শব্দটি যেহেতু সংস্কৃত, ফলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ভারতবর্ষেই এ খাবারের উৎপত্তি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার জন্ম নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ বলেন, প্রথম পোলাও নাকি রান্না হয়েছিল সম্রাট আলেকজান্ডারের জন্য। এশিয়া জয় করতে বেরিয়ে পারস্যের রাজকুমারী রোকসানার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। আর নতুন জামাইকে আদরযত্ন করতে যেসব সুখাদ্য রান্না করা হয়েছিল, তার মধ্যেই ছিল পোলাও। আবার কেউ কেউ বলেন, সমরখন্দ জয় করে সেখানকার মানুষদের খুশি করতে এক ভোজের আয়োজন করেন আলেকজান্ডার, আর সেখানেই স্থানীয় পাচকেরা পোলাও রান্না করেছিলেন। এমনকি পলান্ন নয়, ‘পুলাও’ বা ‘পুলাভ’ শব্দটিও প্রথম ব্যবহার করেছিলেন পারস্য বা আরবের মানুষেরা, এমনটিই বলে থাকেন কোনও কোনও খাদ্য-ইতিহাসবিদ। মনে করা হয়, প্রথম যিনি পোলাও-এর রেসিপি লিপিবদ্ধ করেন তিনিও উজবেকিস্তানের এক পণ্ডিত, নাম আবু আলি হোসাইন ইবনে সিনা।
তবে শুরুটা যেখানেই হোক না কেন, ভারতবর্ষে যে এই খাবার জাঁকিয়ে বসেছিল সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে নবাবি আমলে নানা রঙে ঢঙে পোলাওকে অন্য মাত্রা দেন ওস্তাদ পাচকেরা। তার মধ্যে দুটি পোলাও-এর কথা না বললেই নয়। নবরত্ন পাথরের মতো নয় রংয়ের চাল মিশিয়ে তৈরি করা হত নবরত্ন পোলাও। আর আনারদানা পোলাও-এর প্রতিটি চালের অর্ধেকটা হত চুনির মতো লাল আর বাকি অর্ধেকটা থাকত সাদা কাচের মতো চকচকে। দামি জহরতের মতো সাজানো সেই পোলাও দেখেই চমকে যেতেন অতিথিরা। উৎস যেখানেই হোক না কেন, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এভাবেই পোলাওকে নিজস্ব করে নিয়েছিল ভারতবর্ষ।