আচ্ছা আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে ভূতের ভয়ে নিশ্চয়ই ভগবানের নাম-ও জপ করেন! কিন্তু জানেন কি সেই ভগবানের মন্দিরেও রয়েছে তেনাদের অস্তিত্ব! তাও আবার একটি নয়। ভারতেই রয়েছে এমন বেশ কয়েকটি ভূতুড়ে মন্দির! কোথায় আছে এমন মন্দির? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ভূত আছে কিনা- সেই তর্কের কোনও শেষ নেই। অবিশ্বাসী মন যাই-ই বলুক, কিছু ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা কিন্তু এখনও দিতে পারে না বিজ্ঞান। আবার আত্মার উল্লেখ আমাদের উপনিষদ এবং গীতাতেও আছে। সেখানে বলা হয়েছে, আত্মার সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। এই সত্য উপলব্ধি থেকেই পরবর্তীকালে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে এসেছে নানা রীতি বা প্রথা। কেউ মারা গেলে তাঁর আত্মার উদ্দেশে পিণ্ডদান করতে বলা হয়। এতেই নাকি আত্মার প্রকৃত মুক্তি সম্ভব। কিন্তু মুক্তি না-ঘটলে আত্মা থেকে যায় অতৃপ্ত। কিছু শাস্ত্রীয় ব্যখ্যা, কিছুটা মানুষের বিশ্বাস বা লৌকিক গল্প – সব মিলিয়ে মিশিয়েই তৈরি হয়েছে এক অলৌকিক জগৎ। ভূত নিয়ে মজার গল্প যতই থাকুক, আত্মা বা অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে কিন্তু কেউ সচরাচর মশকরা করে না। এমনকী দেশের বেশ কয়েকটি মন্দিরেও বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ্বাস না হলে ঘুরেই আসুন রাজস্থানের মেহেন্দিপুর বালাজি মন্দির থেকে।
আরও শুনুন: ‘যখন বেঁচে ছিলাম সংগীত চর্চা করতাম…’ আগন্তুকের কথায় হতবাক স্বয়ং গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কী এমন আছে সেই মন্দিরে? এই মন্দিরে তিনটি বিগ্রহের পুজো হয়। বালাজি বা বজরঙ্গবলি, প্রেতরাজ এবং কাল ভৈরব। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, কারও উপর অশুভ শক্তি ভর করলে তা, দূর করা সম্ভব হবে এই মন্দিরে প্রার্থনা করেই। ভোররাত থেকে মন্দিরে প্রবেশের জন্য কাতারে কাতারে মানুষ লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেন। সকালবেলায় মন্দিরের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় ভেতরে ঢোকার হুড়োহুড়ি। যদি এই প্রচণ্ড ভিড়ের ধাক্কা সহ্য করে মন্দিরের ভেতরে ঢুকতে পারেন তো নিশ্চিতই অবাক হয়ে যাবেন। কেননা মন্দিরে পুজোর উপকরণ হিসেবে কোনও ফুল নয়, কালো রঙের এক ধরনের ফল দেওয়া হয়। তা কখনোই খাওয়া যায় না। নিয়মের কারণে নয়, বলতে গেলে এই ফল ভোজ্যই নয়। মন্দিরের ভেতরে সব সময় প্রজ্জ্বলিত থাকে অগ্নি। সেই আগুনে এই ফলের আহুতি দিতে হয়। আবার অন্য যে কোনও মন্দিরের মতো, এর ভিতর থেকে মন্ত্রোচ্চারণ, ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে না। বরং এ-মন্দিরে পা রাখলে আপনাকে স্বাগত জানাবে কান ফাটানো তীক্ষ্ণ চিত্কার, কান্না। ভূতে বিশ্বাস না করলেও এই মন্দিরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আপনার গা ছমছম করবেই। মন্দিরের ভিতরের প্রথম ঘরে কালভৈরবের মূর্তি রয়েছে।
আরও শুনুন: গভীর রাতে দোতলার জানলায় ফিরে ফিরে আসে এক ছায়ামূর্তি…
এরপরের ঘরে আছেন বালাজি। এর পরের ঘর দুটির পরিবেশ বেশ খানিকটা অন্যরকম। তৃতীয় ঘরের দিকে তাকালে যেন দমচাপা ভয় আপনাকে ঘিরে ধরবে। সেখানে তাকালে দেখা যায়, বহু নারী-পুরুষ অসহায় ভাবে কাঁদছে, দেওয়ালে মাথা ঠুকছে। এমনকি অনেকে নিজেই নিজের গায়ে ফুটন্ত গরম জল ঢালছে। যারা মানসিক ভাবে দুর্বল, এখান থেকে ছোট একটি দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারেন। আর শেষ ঘরটিকে নরকের দ্বার বলা যেতেই পারে। সেখানে বহু নারী, পুরুষকে পাথরে বা ঘরের পিলারে মোটা চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। অনেক সময় তাদের প্রহারও করা হয়। দেখেই বোঝা যায়, এরা দীর্ঘদিন অভুক্ত। বলা হয়, এভাবেই এদের ওপর থেকে অশুভ শক্তির প্রভাব কাটানোর চেষ্টা চলছে। এই মন্দির থেকে সঙ্গে আনা যাবে না কোনও প্রসাদ। এমনকি সেই চত্বরে জল খেলেও বিপদ। আর সবথেকে ভয়ংকর কথা হল, মন্দির থেকে ফেরার পথে পিছন ফিরে তাকালেই অশুভ শক্তি আপনার শরীরেও প্রবেশ করতে পারে, এমন সাবধান বাণীই শুনিয়ে রাখেন সকলে। অর্থাৎ, সাধারণ যে সব মন্দিরের কথা আমরা জানি, তার থেকে বেশ আলাদা এই মন্দির-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
আরও শুনুন: শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে নাটক ‘এক ভূতুড়ে কাণ্ড’
এরপর শোনা যাক মধ্যপ্রদেশের দেবজি মহারাজ মন্দিরের কথা। এটিই ভারতের একমাত্র মন্দির, যেখানে আয়োজন করা হয় ‘ভূতের মেলা’র। বলা ভাল, এ হল ভূত তাড়ানোর মেলা। ভোপাল থেকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূরে মালাজপুরের একটি ছোট্ট গ্রামে অবস্থিত এই মন্দির। প্রতিবছর পৌষ পূর্ণিমা থেকে বসন্ত পঞ্চমী পর্যন্ত এখানে অনুষ্ঠিত হয় এই ভূতের মেলা। যার সাক্ষী হতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন। শোনা যায়, এই মন্দিরে বহু প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে ঝাড়ফুঁকের রীতি। মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবজি মহারাজ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত করার ক্ষমতাও ছিল তাঁর আয়ত্তে। তিনি প্রয়াত হলে, তাঁর স্মৃতিতে গ্রামবাসীরা এই মন্দির তৈরি করেন। সেখানেই চলে নানা ধরনের কাজকর্ম। এই ভূতের মেলায় এক অদ্ভুত রীতির প্রচলন আছে। সকালের আরতির পর সাধারণ দর্শনার্থীদের ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে দিকে মন্দিরটি পরিক্রমা করতে বলা হয়। তাদেরই মধ্যে কিছু মানুষ ঘড়ির কাঁটার দিকে মন্দিরটি পরিক্রমা শুরু করেন। তখনই বলা হয় তাঁরা অশুভ শক্তির কবলে পড়েছে। এরপর তাঁদের গায়ে গুরু মহারাজের নামে মন্ত্রপুতঃ জল ছেটানো হলেই তাঁরা অস্বাভাবিক আচরণ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এই ঘটনার সাক্ষী যাঁরা থাকেন, ভয় না পেয়ে তাঁরা যাবেন কোথায়!
তালিকার পরবর্তী নামটি কর্ণাটকের একটি মন্দিরের। গঙ্গাপুরের দত্তাত্রেয় মন্দির। মন্দিরের অধিষ্ঠিত ভগবান দত্তাত্রেয় আসলে শিবেরই এক রূপ। ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁর মন্দির থাকলেও এই মন্দিরটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানেও মানুষ আসেন অশুভ শক্তির প্রকোপ থেকে মুক্তি লাভের আশায়। ঘোর অমাবস্যার দিনে মন্দিরে আয়োজন করা এক বিশেষ আরতির। বিশেষ কেন বলছি জানেন? কারণ এখানে আরতির সময় ঈশ্বরবন্দনার বদলে করা হয় উচ্চৈঃস্বরে তিরষ্কার। এমনকি অনেকে মন্দিরে দেওয়ালে আঁচড় কাটতে থাকেন বা ঘণ্টা ধরেই ঝুলতে থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস এভাবেই নাকি তাঁদের শরীর থেকে অশুভ প্রভাব কেটে যায়। এমন অদ্ভুত ঘটনা বোধহয় ভারতের আর কোনও মন্দিরে হয় না।
এখানেই শেষ নয়। এর পরে যে মন্দিরটির কথা বলব, সেটি দেবী চণ্ডীর। পুরাণ অনুসারে দেবী দুর্গার উগ্র রূপগুলির মধ্যে অন্যতম হলেন এই চণ্ডী। মন্দিরটি রয়েছে উত্তরপ্রেদেশের হরিদ্বারে। নবরাত্রির সময় এই মন্দিরে ভিড় হয় চোখে পড়ার মতো। ভক্তদের বিশ্বাস দেবীর এই উগ্র রূপ যে-কোনও ধরনের অশুভ প্রভাব থেকে তাঁদের মুক্তি দেবে। তাই সারাবছরই এই মন্দিরে মানুষ আসেন অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির আশায়।
আরও শুনুন: কিশোরীদের রক্তে স্নান, ৬০০ জনকে খুন, কুখ্যাত মহিলা সিরিয়াল কিলারের রুদ্ধশ্বাস গল্প
তালিকায় সবশেষে রয়েছে বিহারের হারশু ভ্রম মন্দির। এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে এক জনশ্রুতি। হারশু নামে জনৈক ব্রাহ্মণ জীবদ্দশায় চাইতেন সবাই তাঁর পুজো করুক। মারা যাওয়ার পরেও নাকি তাঁর অতৃপ্ত আত্মা একই আশা নিয়ে এই মন্দিরের আশেপাশে ঘুরতে থাকেন। তাঁর কাছে এলেই নাকি মুক্তি পাওয়া যায় অন্যান্য অশুভ শক্তির থেকে। তাই বহুদূর থেকে মানুষ ছুটে আসেন এই মন্দিরে সুস্থ হওয়ার আশায়। এলাকায় প্রত্যেকের মুখেই এই মন্দিরের অলৌকিক ঘটনা ঘুরতে থাকে।
আরও শুনুন: পুলিশের ঘুম ছুটিয়েছিল কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার
পুজো-অর্চনা, মনস্কামনা পূরণের জন্য নানারকম প্রথা পালন- ভারতবর্ষের যে কোনও মন্দিরেই দেখা যায়। তবে অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি লাভের জন্যেও যে মানুষ মন্দিরের দরজায় এসে উপস্থিত হন, তা বেশ অবাক করার মতোই ঘটনা। ভারতীয় সভ্যতায় বহু জনজাতির বিশ্বাস যে বিচিত্র সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, এই মন্দিরগুলি যেন তারই চিহ্ন বহন করে চলেছে। ভূতুড়ে বলুন বা অলৌকিক কিংবা অদ্ভুত- এই মন্দিরগুলি যে সত্যিই ব্যতিক্রমী, তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।