সমানাধিকারের ধারণা নিয়ে যত কথা হচ্ছে, তত বেশি করে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, নারী বা পুরুষ যে কেউই নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। লিঙ্গবৈষম্য না করেই সেই নির্যাতনের পালটা ন্যায়বিচার আসা উচিত। পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতার আস্ফালনে যেমন সে বিচার চাপা পড়ার কথা নয়, তেমনই নারীবান্ধব আইনের অপব্যবহারেও সেই বিচারের পথ হারানো উচিত নয়।
কে নির্যাতক হয়ে উঠবে আর কে নির্যাতিত, লিঙ্গভেদে তা ঠিক করে দেওয়া যায় না। তাই, নারীর মতোই গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হতে পারেন কোনও পুরুষও। সম্প্রতি বেঙ্গালুরুর এক যুবকের আত্মহত্যা এই কথাটিই যেন মনে করিয়ে দিল।
যদিও সমাজে নারীর সঙ্গে দুর্বলের আর পুরুষের সঙ্গে ক্ষমতাবানের সমীকরণ টানা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে, কোনও পুরুষও যে নিগ্রহ বা হেনস্তার মুখে পড়তে পারেন, সে কথা আমরা যেন সহজে মনেই করে উঠতে পারি না। একইভাবে, যে পুরুষ নির্যাতিত, তিনিও অনেকসময়ে ওই ‘মেল ইগো’ পেরিয়ে সে কথা বলেই উঠতে পারেন না। কিন্তু নির্যাতনের ইতিহাস তাতে মিথ্যা হয়ে যায় না। বরং সময় যত এগোচ্ছে, সমানাধিকারের ধারণা নিয়ে যত কথা হচ্ছে, তত বেশি করে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, নারী বা পুরুষ যে কেউই নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। লিঙ্গবৈষম্য না করেই সেই নির্যাতনের পালটা ন্যায়বিচার আসা উচিত। পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতার আস্ফালনে যেমন সে বিচার চাপা পড়ার কথা নয়, তেমনই নারীবান্ধব আইনের অপব্যবহারেও সেই বিচারের পথ হারানো উচিত নয়। সম্প্রতি সে কথাটিই মনে করিয়ে দিল খোদ সুপ্রিম কোর্ট। আর মনে করাল এমনই এক সময়ে, যখন এমনই এক অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে, বিচার না পাওয়ার কথা বলে নিজেকে শেষ করার পথ বেছে নিয়েছেন ওই যুবক।
স্ত্রী লাগাতার মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন তাঁর বিরুদ্ধে, সুইসাইড নোট এবং মৃত্যুর আগে রেকর্ড করা ভিডিও বার্তায় বারবার সে কথা বলেছেন আত্মঘাতী যুবক অতুল সুভাষ। বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা ওই যুবক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রীও চাকরিজীবী। তবে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলাকালীন মাসিক ৪০ হাজার টাকা খোরপোশ দিতে হয় অতুলকে। এর পরেও অতুলের স্ত্রী ও তাঁর পরিবার আরও টাকা দাবি করছিলেন বলে অভিযোগ। অতুলের পরিবারের দাবি, নির্যাতন-হিংসার একের পর এক ‘মিথ্যা’ অভিযোগ তুলে অতুলকে ফাঁসানো হয়, তারপর মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তিন কোটি টাকা দাবি করা হয় স্ত্রীর তরফে। মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য বেঙ্গালুরু থেকে উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরে পারিবারিক আদালতে অন্তত ৪০ বার ছুটে আসতে হয়েছে অতুলকে, বলছে পরিবার। সেখানে বিবাহবিচ্ছেদের মামলার রায় তাঁর বিপক্ষেই গিয়েছিল। ২৪ পাতার সুইসাইড নোটের প্রতি পাতায় অতুল লিখেছেন, বিচার এখনও বাকি। আর এই পরিস্থিতিতেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি নারীনির্যাতন বা গার্হস্থ্য হিংসার আইনের অপব্যবহার ঘটেছে এক্ষেত্রে?
ঘটনাচক্রে এই পরিস্থিতিতেই সামনে এসেছে সুপ্রিম কোর্টের এক পর্যবেক্ষণ। যেখানে দেশের শীর্ষ আদালত কার্যত সতর্ক করেছে এই আইনগুলির অপব্যবহার নিয়ে। সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, ৪৯৮ ধারার মূল লক্ষ্য গার্হস্থ্য হিংসা থেকে মহিলাদের রক্ষা করা। কিন্তু সেই আইনকে অনেক ক্ষেত্রে স্বামী এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ‘ব্যক্তিগত আক্রোশ’ মেটানোর অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ আদালতের। সম্প্রতি এক ব্যক্তি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জানাতেই তাঁর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর আচরণের অভিযোগ তুলে পালটা মামলা দায়ের করেন স্ত্রী। সেই মামলার প্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের হুঁশিয়ারি, বৈবাহিক সম্পর্কে মহিলাদের সুরক্ষা দিতে যে আইন তৈরি হয়েছে, ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে তার অপব্যবহার করা চলে না।
আর এখানেই আশঙ্কা, এই অপব্যবহার যদি বারেবারে ঘটে, এমনকি খোদ শীর্ষ আদালতকেও তা নিয়ে চেতাবনি জারি করতে হয়, তাহলে কোথাও গিয়ে নারীদের অধিকারের প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না তো? যে সমাজে পুরুষতন্ত্র কায়েম রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে, সেখানে নারী যে ‘অপর’, সামাজিক ক্ষমতার প্রেক্ষিতে পিছিয়ে থাকা- তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সে কারণেই তাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনকানুনও প্রয়োজন। কিন্তু সেই আইনের অপব্যবহার বারবার ঘটলে আইনের যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। আর সেই পরিস্থিতিতে নির্যাতিতাদের বিচার পাওয়ার লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তেমনটা যাতে না হয়, সে কারণেই মনে রাখা জরুরি যে, নির্যাতক বা নির্যাতিতের লিঙ্গভেদ হয় না। পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে নারীর উপর অত্যাচারের ঘটনা বেশি ঘটার পরিসর রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার পাশাপাশি পুরুষও যে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হতে পারেন সে কথাকেও মনে রাখতে হবে। না হলে নারীকেন্দ্রিক আইনের অপব্যবহারের সুযোগও বাড়বে, আর তাতে লঘু হয়ে পড়বে নারীর অধিকারের ক্ষেত্রটিই।