টকটকে লাল হার্ট ইমোজিও সচরাচর কেউ পাঠান না। আপনি খেয়াল করে দেখতে পারেন, আরও বহু রঙের লাভ সাইন পাওয়া যায়। হয়তো ভাববেন, এত সাইনের কাজ কী! কিন্তু তরুণ প্রজন্মের কাছে, সেগুলোই কাজের, চড় করে লাল হার্ট সাইন পাঠানো কোনও কাজের কথা নয়। শুনলে অবাক হতে হয় যে, সাদা রঙের হার্ট সাইন-ই নাকি এখন মনের যাবতীয় কথা বলে দেয়।
তরুণের পূর্বরাগ। ভালো লেগেছে কোনও তরুণীকে। আজকের প্রজন্ম অবশ্য এই এত কথার ধারই ধারে না। স্রেফ ‘ক্রাশ’ বললেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে কি ফ্লার্ট করে কি সেই তরুণ তাঁর ক্রাশকে ‘স্মোকিং হট’ বলে ফেলবে! কথাটা চালু সন্দেহ নেই। এক কালে বলাও হত। কিন্তু একালের কোনও তরুণ এ-কথা ভুল করেও ব্যবহার করবেন না। কেননা, ‘স্মোকিং কিল্স’। তার উপর দূষণের এই রমরমা। বাতাসের যে হাল তাতে স্মোকিং বিশেষণের প্রয়োগ নৈব নৈব চ। যেমন ‘বম্ব’ শব্দটিও বাতিল হয়েছে। যে অর্থেই তা প্রয়োগ করা হোক না কেন, তা যুদ্ধের অনুষঙ্গ বয়ে আনে। গণহত্যার স্মৃতির সঙ্গে তা জড়িয়ে। সুতরাং ফ্লার্টিং হোক আর যা-ই হোক, এই শব্দ কেউ ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করবেন না।
এখন, ফ্লার্টিং ভালো কি মন্দ- তা তর্কের বিষয়। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রেম-প্রেম হাওয়ায় এখনও তা দিব্যি টিকে আছে। কেউ কেউ আবার ফ্লার্টিং-এর প্রকারভেদও করেছেন। গুড আর ব্যাড কোলেস্টেরলের মতো, ফ্লার্টিং-এরও নাকি ভালো-মন্দ আছে! ফ্লার্টিং-এর ডিফেন্সে মজা করে সে-কথা বললে, উলটোদিকের মানুষটি আর কী করবেন, হেসেই ফেলেন। বছরকয়েক আগের সিনেমা ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিবানি’-র একটি সংলাপ অনেকের মনে পড়তে পারে। নায়ক বানি সেখানে বলেছিল, ফ্লার্টিং নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী, তা ‘যোগা’র মতো ভালো। এখন কি সে কথা প্রযোজ্য? জেন জেড বলছে, মোটেও না, ওসব ধারনা এবং কথাবার্তা তামাদি হয়ে গিয়েছে। তাঁরা অন্তত এই ধরনের কথাবার্তা একদমই পছন্দ করেন না। অতএব যেখানে টক্সিসিটির চাষবাদ সে মাঠে তাঁরা মোটেও পা রাখবেন না, এ একরকম নিশ্চিত।
আরও শুনুন: Flex, Woke, Cancel Culture ঘুরছে নতুন প্রজন্মের মুখের ভাষায়, অর্থ জানেন?
খেয়াল রাখতে হবে যে, যে প্রজন্মের কথা হচ্ছে, তাঁরা কিন্তু তাঁদের সমসময় সম্পর্কে খুবই সচেতন। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই প্যাট্রিয়ার্কি, হাইপার ম্যাসকুলিনিটি এবং টক্সিক কথাবার্তার জগৎটিকে তাঁরা সযত্নে পরিহার করেছেন। এই বিষয়গুলি নিয়ে সচেতনতা যে আগেও ছিল না, তা নয়। দেশ-কাল সম্পর্কে অনেকেই ছিলেন দারুণ ওয়াকিবহাল। কিন্তু দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহারে, এমনকী প্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে যে অজান্তে পুরনো ধ্যানধারনাই তাঁরা বয়ে নিয়ে চলছেন, এটা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা খেয়াল করেননি। বা বহুদিন ধরে চলে আসছে বলে পুনরায় ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। তবে গড় প্রবণতা বলছে, ভাষার ব্যবহারে সচেতনতার খানিক অভাব ছিলই। তবে এই প্রজন্ম নিজেদের বলে ‘ওক জেনারেশন’, অর্থাৎ তাঁরা সব বিষয়ে সদাজাগ্রত। সেই জাগরণের ছাপ পড়ছে তাঁদের ভাষার ব্যবহারেও। প্রেম থেকে যৌনতা, কোনও বিষয়ে তাঁদের ট্যাবু নেই। সরাসরি যে কোনও বিষয়ে কথা বলতেই তাঁরা পছন্দ করেন। অন্যায় হলে রুখে দাঁড়াতেও পিছপা হন না। সেই সঙ্গে তাঁরা পূর্বসূরির কাজে-কথায় যা কিছু টক্সিক এলিমেন্ট, তাও চিহ্নিত করছেন। এবং তা বাদ দিয়েই খুঁজে নিচ্ছেন নিজেদের প্রেমের হালকা ভাষা।
কী সেই ভাষার ধরন? কিছুদিন আগেও হয়তো ভাবা যেত না, তবে এখনকার প্রজন্ম জানে, ডেটিং অ্যাপে যার সঙ্গে ম্যাচ হয়েছে, তাঁর ইনস্টাগ্রাম স্টোরি লাইক করার অর্থ আসলে ফ্লার্টিং-ই। বা, কোনও রোম্যান্টিক পপ-কালচারের পোস্ট শেয়ার করে যদি জানতে চাওয়া হয় ‘এরকমটা কি আমাদের সঙ্গেও হবে?’, তবে বুঝতে হবে, এ হল ফ্লার্টিং-এর লক্ষণ। কিংবা ধরুণ, নেহাত ছাপোষা একটা প্রশ্ন এল- ‘আপনার রাশি কী?’ আগের প্রজন্ম কেউ এ নিয়ে মাথাও ঘামাবেন না। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম জানে, এর মধ্যে ফ্লার্টিং-এর সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে। এমনকী টকটকে লাল হার্ট ইমোজিও সচরাচর কেউ পাঠান না। আপনি খেয়াল করে দেখতে পারেন, আরও বহু রঙের লাভ সাইন পাওয়া যায়। হয়তো ভাববেন, এত সাইনের কাজ কী! কিন্তু তরুণ প্রজন্মের কাছে, সেগুলোই কাজের, চড় করে লাল হার্ট সাইন পাঠানো কোনও কাজের কথা নয়। শুনলে অবাক হতে হয় যে, সাদা রঙের হার্ট সাইন-ই নাকি এখন মনের যাবতীয় কথা বলে দেয়।
আরও শুনুন: শরীরী ভাষায় শরীরের স্বাধীনতা… বডিশেমিং-এর সপাট জবাব দিয়েছেন এই অভিনেত্রীরা
এই ভাষা বদল আসলে একটি প্রজন্মের মানসিকতা বদলেরই আভাস দেয়। ফ্লার্টিং উচিত না অনুচিত তা চিরকালই প্রশ্নের বিষয়। আজও সে প্রশ্ন যে নেই, তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন উড়িয়ে যদি কেউ ফ্লার্টিং করেও থাকেন, তিনি কিন্তু পুরনো ভষার আশ্রয় নিচ্ছেন না। এমনকী আলটপকা কথা না বলে, ইউ টিউব ঘেঁটে তাঁরা দেখে নিচ্ছেন, ফ্লার্টিং-এর নতুন ভাষা কী! কেননা এই সংক্রান্ত পুরনো ধ্যানধারণার বদল হচ্ছে। প্রেম প্রকাশের ভাষা যুগে যুগে বদলায়। নতুন প্রজন্মও তাঁদের মতো করেই ভাষা খুঁজে নিচ্ছে। আর সেই ভাষা বদলের মধ্যে থেকে যাচ্ছে সচেতনতার অনেকখানি জায়গা। ভাষার নেপথ্যে এই সচেতনতার চিহ্নটুকু কিন্তু স্বীকার করে নিতেই হয়।