জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের ভার মেয়েদের মাথায়। তবু পান থেকে চুন খসলেই কথা শোনাতে পিছপা হয় না বাড়ির লোক। কথায় কথায় অপমান শুধু মনের কষ্ট নয়, ডেকে আনতে পারে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগও।
ইচ্ছে-অনিচ্ছে, এমনকী ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের নানান আচরণেও অসহায় লাগে হয়তো। অথচ চক্ষুলজ্জায় কাউকে বলতে পারেন না কিচ্ছুটি। কারণ পরিবার, সমাজ সবাই আপনাকে শিখিয়েছে এসব কথা বলতে নেই। পুরুষমানুষ একটু-আধটু রাগ করেই থাকে। এমনকি গায়ে হাত তুললেও অনেকসময় বলা হয় একটু মানিয়ে নিতে। স্বামীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজের বশে আনাই নাকি নারীজন্মের সার্থকতা। কিন্তু, ‘এমনটা তো হয়েই থাকে’ বলে এই যে সবকিছুকেই স্বাভাবিক করে তোলা, এর জেরে কোথায় কীভাবে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে জানেন কি?
না, মনের ক্ষতির কথা বলছি না কেবল। এভাবেই ধীরে ধীরে কখন যে মারণব্যাধি চেপে বসেছে বাড়ির মহিলাদের ভিতরে, তার খোঁজ কি কেউ রাখে? সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী জানা গেছে, পারিবারিক হিংসার দিক থেকে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকের হাতে বধূ নির্যাতনের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। আর এই নির্যাতন যে সবসময় গায়ে-পিঠে হাত তুলেই করতে হবে তা কিন্তু নয়। একান্ত মুহূর্তে, আদরের ভাষাও হয়ে উঠতে পারে অত্যাচারের শামিল। সঙ্গীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সংলাপ, আদরের বিভিন্ন রকম-সকম হয়তো আপনার পছন্দ নয়। কিন্তু সেই অনিচ্ছা তাঁর জোরজবরদস্তির মুখে টেকে না। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন হাসিমুখে অনিচ্ছাগুলো গিলে নিলেও হতে পারে সমস্যা। এই সমস্যা চোখে দেখা যায় না বলে, এর ভার যে খুব কম, তা ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং এই ছোটো ছোটো অপ্রাপ্তি জমতে জমতে হতে পারে গভীর হতাশা। যা বাড়িয়ে তুলতে পারে হৃদরোগের ঝুঁকি। উচ্চ রক্তচাপ, অবসাদের মতো আরও অজস্র রোগ বাসা বাঁধতে পারে আপনার শরীরে। আর তার শেষ ফলাফল হল কঠিন হৃদরোগ। সম্প্রতি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে যে, গৃহবধূদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মহিলাদের হার্ট অ্যাটাকের কারণ হল পারিবারিক হিংসা, বলা ভালো, সঙ্গীর নির্যাতন। আর এই পরিসংখ্যানটি সমগ্র বিশ্বজুড়েই বাড়িয়েছে তার ভয়াল থাবা।
আরও শুনুন: নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দেশজুড়ে, অথচ সিরিয়াল জুড়ে সেই গার্হস্থ্য হিংসা
আপনাদের মনে আছে শ্রদ্ধা-আফতাবের কথা? সালটা ছিল ২০২২। দিল্লির শ্রদ্ধা ভালোবেসে হাত ধরেছিল আফতাবের। আর তার ফলাফল ছিল মৃত্যু। এখানেই শেষ নয়, শ্রদ্ধার মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে আফতাব ফ্রিজবন্দি করেছিল। ইদানীং এমন আরও ঘটনা চোখে পড়ে, যেখানে প্রেম বা লিভ-ইন সম্পর্ক, যা দুজনের স্বাধীন সিদ্ধান্তকেই চেনায়, তেমন সম্পর্কেও প্রেমিকের থেকে নির্যাতন পেতে হচ্ছে মেয়েটিকে। আর সেই আচরণই গভীর প্রভাব ফেলছে মেয়েদের শরীরের অন্দরমহলে। তাহলেই ভাবুন, লিভ-ইন সম্পর্কের মতো স্বাধীন সম্পর্কগুলিই যেখানে আজও পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসন থেকে মুক্তি পায়নি, সেখানে বিয়ের মতো একটি সামাজিক প্রথায় মেয়েদের অবস্থান তো আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
বারবার মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার খবর ঘুম কেড়েছে সকলের। নারী সুরক্ষা নিয়ে হাজার পরিকল্পনা কিংবা পরিকাঠামো গড়ে উঠছে প্রতিদিন। কিন্তু এই বজ্র আঁটুনির মধ্যেও ফস্কা গেরো তো কম থাকছে না! যদি নারীর বেঁচে থাকাটুকুই সহজ না করা যায় তাহলে লাভ কী? নারীকে দেবী বলে সম্মান করা মুলতুবি রেখে বরং তার শরীর এবং মনের চোরাকুঠুরিতে আলো ঠিকরে পড়ুক, পাশাপাশি আলো পড়ুক পুরুষতান্ত্রিকতার অন্ধ খোপেও- যাতে অ-সুখ থেকে মুক্তির চাবি খুঁজে পাওয়া যায়।