সব পাখি মাছ খায়, আর নাম হয় কেবল মাছরাঙার! সেরকমই, মেছো বলে বদনাম জোটে কেবল বাঙালিরই, কিন্তু মাছ খাওয়ায় পিছিয়ে ছিলেন না কলকাতা শাসন করা সাহেবের দলও। আর তাঁদের ফেভারিট ডিশ ছিল ম্যাঙ্গো ফিশ। উঁহু, এর সঙ্গে আমের কোনও যোগ নেই দূরদূরান্ত অবধি। তবে? এ আবার কী মাছ?
বর্ষা পড়ল তো সাজ সাজ রব। একদিকে সাজানো হচ্ছে বড় বড় নৌকো। খাবারদাবার, ফলমূল, রঙিন জল, নির্দোষ পানীয়, কিছুই বাদ নেই। খোদ সাহেবরা যাবেন নৌকাবিহারে, এটুকু না হলে চলে! সাহেব মানে কিন্তু আজকের বাঙালি অবাঙালি অফিসের বড়কর্তারা নন, খাস বিলেত থেকে আসা লালমুখো পাক্কা সাহেব। সময়টা যে আঠেরো শতক, বড়জোর উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিক। তা সাহেবরা চলেছেন, তাঁদের সঙ্গে অতি অবশ্যই চলেছে একঝাঁক ‘কোই হ্যায়’। বুঝলেন না তো? আরে, কাজ থাক আর না থাক, কথায় কথায় ‘কোই হ্যায়’ বলে হাঁক না পাড়লে সাহেবদের মন ভরে না যে। সুতরাং, দশ-বারোটা চাকরবাকর না থাকলে চলে! নৌকায় চলেছে তারাও। আর চলছে খানসামা-বাবুর্চি।
আরও শুনুন: Hilsa: ইলিশ মাছকে নাকি সেকালে ভাবা হত ‘নিরামিষ’! কেন জানেন?
আসলে, সাহেবরা যে চলেছেন মাছ শিকারে! ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’-র বাংলা প্রবাদটি তাঁদের জানা ছিল কি ছিল না কে জানে, কিন্তু মাছ খাওয়ার আনন্দ জানা ছিল পুরো মাত্রায়। এমনিতেই ইংরেজরা মেছো জাত। বাঙালির মতো মাছ ভাত না খাক, মাছ খাওয়ার পরিমাণের দিক থেকে তারা বাঙালিকে বলে বলে গোল দেবে। কারণ, ইংরেজরা মাথা পিছু বছরে মাছ খায় ৪৯ পাউন্ড বা প্রায় আধ মন। আর বাঙালির পেটে মাছের বার্ষিক পরিমাণ মাত্র ৯ পাউন্ড। এহেন ইংরেজদের জিভে জল এল বাংলায় এসে হরেক রকম মাছ দেখে। আর সব মাছের মধ্যে তাঁদের সবচেয়ে পেয়ারের ছিল তপসে মাছ। যার ভাল নাম তপস্বী। একজন সাহেব লিখেছেন, নেটিভরা এই মাছের নাম রেখেছে তাদের এক ধর্মীয় প্রজাতির নামে। তারাও কখনও দাড়ি গোঁফ কামায় না। আর তাদের মতোই, বর্ষাকাল এলেই এই মাছ উধাও হয়ে যায়। সাহেবরা অবশ্য এই মাছের নাম রেখেছিলেন ম্যাঙ্গো ফিশ। কেন? না, আমের মরশুমেই এর আবির্ভাব। আর এর গন্ধের সঙ্গেও নাকি আমের গন্ধের দিব্যি মিল।
আরও শুনুন: বাঙালির নাকি মাছ খাওয়া বারণ! কী বলছে পুরাণ?
বর্ষা এলে তপসের দেখা মেলে না। আর তার বিরহে সাহেবরা কাতর হয়ে পড়েন। অতএব, বর্ষা শুরু হলেই সাহেবরা নৌকো নিয়ে হানা দিতেন কলকাতার আশেপাশে। উলুবেড়ের এদিকে নাকি ম্যাঙ্গো ফিশ আসে না। সুতরাং কলকাতার বাইরে দশ-পনেরো মাইল জুড়ে চলত মাছ ধরার তোড়জোড়।
তপসে মাছের স্বাদ যাঁরা পেয়েছেন, সাহেবদের মাছ ধরার গল্প শুনে তাঁরা অবাক হবেন না। আর যাঁরা পাননি, তাঁরা শুনুন, এক অবসর নেওয়া কর্নেল কী বলেছিলেন। তাঁর মত ছিল, বিলেত থেকে কলকাতার ক’মাসের সমুদ্রযাত্রার ধকল অনায়াসে নেওয়া চলে, যদি কপালে জোটে এক ডিশ তপসে মাছ! মৎস্যপ্রেমী হিসেবে তাই শুধু বাঙালি নয়, সাহেবরাও যে কম যান না, সে তো বোঝাই যাচ্ছে।