৬-১৪ বছর বয়সী সমস্ত শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক বুনিয়াদি শিক্ষার অধিকার সুরক্ষিত করেছে ভারতীয় সংবিধান। তবে তা খাতায়-কলমে স্বীকৃত হলেও সত্যিই কি সেই সুবিধাটুকু পায় দেশের সমস্ত শিশু? এদিকে, কোভিড পরবর্তী সময়ে স্কুলছুট শিশুর সংখ্যাটা রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলার মতোই। আর তার নেপথ্যের বড় কারণটা আজও সম্ভবত অর্থনৈতিক দূরবস্থাই। বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ সরকার দিচ্ছে বটে, কিন্তু বাকি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কি পাচ্ছে অনগ্রসর এলাকার শিশুরা। পরিবহণ থেকে শুরু করে সমস্যা রয়েছে অনেক। সমাধান অধরা। সম্প্রতি সরকারি একটি সমীক্ষা জানিয়েছে, দেশের মোট পড়ুয়ার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশকেই স্কুলে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। তা দূরত্ব যা-ই হোক না কেন। আর কী বলছে সেই সমীক্ষা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বিনামূল্যে সমস্ত শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে বদ্ধপরিকর সরকার। তবে বাস্তবে কি ব্যাপারটা সত্যিই এতটা জলবৎ তরল। আজও প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলছুট হওয়ার সংখ্যাটা রীতিমতো চিন্তায় ফেলার মতোই। মিডডে মিল থেকে শুরু করে হাজার রকম প্রকল্প, সাহায্য সত্ত্বেও আজও দুটো টাকা রোজগারের জন্য স্কুল ছাড়ে অসংখ্যা শিশু। রজঃস্বলা হতে না হতেই স্কুল ছাড়তে হয় অসংখ্য মেয়েকে। করোনা পরবর্তী সময়ের ছবিটা তো আরও ভয়াবহ। অনলাইন পড়াশোনা আয়ত্ত করতে না পেরে স্কুল ছেড়েছে অনেকে। মিড ডে মিল না পেয়ে চরম সংকটে পড়তে হয়েছে বহু পরিবারকে। সরকার প্রাথমিক স্কুল গড়ে দিয়েছে বটে। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে সেই স্কুলের দূরত্ব এতটাই বেশি যে সেখানে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করাটা যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়ে পড়ুয়াদের জন্য। বাস, অটোর মতো গণপরিবহণে যাতায়াত করার মতো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নেই অনেকেরই। ফলে অল্প বয়সেই ছাড়তে হয় স্কুল। লেগে পড়তে হয় রুজির টানে।
আরও শুনুন: একটাই ব্ল্যাকবোর্ডে পড়ানো হচ্ছে হিন্দি ও উর্দু, সমন্বয়ের ভারতবর্ষের অন্য প্রকাশ শিক্ষাঙ্গনে
না, এ যে কেবল কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের সমীক্ষাই। কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের ডিপার্টমেন্ট অব স্কুল এডুকেশন অ্যান্ড লিটারেসি সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। ২০২১ সালের সেই ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট সার্ভের রিপোর্ট অবশ্য অবাক করার মতোই। রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ পড়ুয়াকে স্কুলে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। মাত্র ১৮ শতাংশ পড়ুয়া স্কুলে যায় নিজেরা সাইকেল চালিয়ে। তবে সেই সাইকেলের সুবিধাটুকু থেকেও বঞ্চিত পড়ুয়াদের বড় অংশ।
দেশের বহু স্কুলেই ব্যাক্তিগত পরিবহণ ব্যাবস্থা চালু রয়েছে। তবে সেসবের সুবিধা পায় খুব সামান্য অংশই। রিপোর্ট জানাচ্ছে, তৃতীয়, পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণির খুব সীমিত সংখ্যক পড়ুয়া স্কুলবাসে যাতায়াত করে। গোটা দেশের হিসেবে সেই সংখ্যাটা মাত্র ৯ শতাংশ। বেসরকারি বাসে যাতায়াত করেন আরও ৯ শতাংশ। ৮ শতাংশ পড়ুয়া অভিভাবকের বাইক বা মোটরসাইকেলে করে স্কুলে আসে। বাড়ির চারচাকা গাড়িতে স্কুলে আসে মাত্র ৩ শতাংশ পড়ুয়া।
আরও শুনুন: অভিনব উদ্যোগ… ঋতুস্রাবের ট্যাবু কাটাতে ভারতের ৭ রাজ্যে আয়োজন উৎসবের
কেন্দ্রীয় সরকারি ওই সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিল দেশের ৭২০টি জেলার অন্তত ১ লক্ষ ১৮ হাজার স্কুল ও তাদের প্রায় ৩৪ লক্ষ পড়ুয়া। সেখানে শহরাঞ্চল যেমন ছিল, ছিল প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলগুলিও। সেই রিপোর্ট জানিয়েছে, করোনাকালীন সময়ে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে পড়ুয়াদের একটি বড় অংশ। ২৪ শতাংশ পড়ুয়ার কাছে কোনওরকম অনলাইন ডিভাইসের সুবিধা ছিল না। অনলাইন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সমস্যায় পড়েছে ৩৮ শতাংশ পড়ুয়া। যদিও করোনা ফাঁড়া কাটিয়ে ইতিমধ্যেই খুলে গিয়েছে স্কুল। তবে করোনাকালীন সময়ে স্কুলছুট পড়ুয়ারা কতটা ফিরতে পেরেছে ফের পড়াশোনায়, তা নিয়ে কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ মিললেও পারিপার্শ্বিক হাজারটা অসুবিধার কারণে আজও পড়াশোনা করতে পারছে না দেশের বহু পড়ুয়াই। আর তা ফের একবার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে এই সমীক্ষা থেকেই। ফলে কেবল শিক্ষার অধিকার সুরক্ষিত করলেই হবে না, স্কুল পর্যন্ত পড়ুয়াদের পৌঁছে দিতে এবং পড়াশোনা চালিয়ে যেতেও তাদের সাহায্য করতে হবে সরকারকেই। তেমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের।