মাটির আশ্রয়ে, ভূমির কাছাকাছি থাকতে থাকতে কোনও এক সময় থেকে মানুষের ভিতরে চেপে বসলো মাটিকে গ্রাস করার ইচ্ছে। দখল হতে থাকল ভূমি। তৈরি হতে থাকল বহুতল ইমারত। নির্মম কোপে কেটে ফেলা হল গাছ, উড়িয়ে দেওয়া হল বনাঞ্চল। মাটির স্তরে স্তরে জমল বর্জ্য। দ্রুত নষ্ট হতে থাকল মাটির ভৌত অবস্থা। আর তারপর?
‘মাটি’। দুটি অক্ষরে গাঁথা একটিমাত্র শব্দ। শুরুতেই ‘মা’। যে অক্ষরটিকে ঘিরে রয়েছে আমাদের আজীবনের আবেগ, বেঁচে থাকার যাবতীয় গল্প। আর তার সঙ্গে যখনই পরের অক্ষরটি জুড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে মিশে যায় ঘরে ফেরার আকুলতা, শিকড়ের টান।
যে শব্দ হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেয় প্রেম-ভালোবাসার কথা, সেই শব্দই যেন কারণ হয়ে ওঠে রক্তপাতের, বিভাজনের, বিচ্ছেদের।
মহাভারতের পাতায় ছিল দম্ভের সংলাপ– ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। আর সেই মেদিনীকে রক্ষা কিংবা অধিকার করার তাগিদেই যেন পেরিয়ে গেছে মহাভারতের বাদবাকি অধ্যায়গুলি। তবে এই ইতিহাস কিন্তু আদৌ সেখানে থেমে থাকেনি। বরং যুগের পর যুগ ধরে মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে ভূমি কেড়ে নেওয়ার ইচ্ছে, মানুষকে ভূমিচ্যুত করার ইচ্ছে।
তাই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের পাতায় খুব বড় একটি জায়গা জুড়ে রয়েছে দেশভাগ। যার কারণে একদিন লক্ষাধিক উদ্বাস্তু মানুষকে ঠাঁই পেতে হয়েছিল রাস্তায়। পরবর্তীতে পড়ে থাকা সেই মাটির নাম হয়েছিল কলোনি। কিন্তু সেই কলোনিও কি শেষাবধি টিকে থাকল? থাকল না। মাটির আশ্রয়ে, ভূমির কাছাকাছি থাকতে থাকতে কোনও এক সময় থেকে মানুষের ভিতরে চেপে বসলো মাটিকে গ্রাস করার ইচ্ছে। দখল হতে থাকল ভূমি। তৈরি হতে থাকল বহুতল ইমারত। নির্মম কোপে কেটে ফেলা হল গাছ, উড়িয়ে দেওয়া হল বনাঞ্চল। মাটির স্তরে স্তরে জমল বর্জ্য। দ্রুত নষ্ট হতে থাকল মাটির ভৌত অবস্থা।
আর এসবের মধ্যেই কখন যেন মাটি হারিয়ে যেতে থাকল পরিবেশ থেকে। শুধু কি তাই? নতুন পৃথিবীতে চলছে ভয়াবহ গতিতে ভূমিক্ষয়। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রকাশ করেছে একটি প্রতিবেদন। সেখানে জানানো হয়েছে, ইতিমধ্যেই ১ কোটি ৫০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার ভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে পৃথিবী থেকে। প্রকৃতিকে দূষিত করা নিয়ে মানুষের মধ্যে সতর্কতার শেষ নেই। শেষ নেই প্রচারের, সতর্কতামূলক কাজেরও। কিন্তু তবুও প্রতি বছর বছর বাড়ছে আরও কয়েক দফা ক্ষতির পরিমাণ।
আরও শুনুন: সমুদ্র ভরেছে প্লাস্টিক বর্জ্যে, মিটিংয়েই ব্যস্ত নেতারা! দূষণকে নেল-আর্টে বদলে বার্তা শিল্পীর
নতুন প্রজন্ম হয়তো তেমন করে জানে না দেশের মাটি হারানোর বেদনা। নতুন প্রজন্ম জানে না মাটির দেশ হারানোর সংকট। আর তাই-ই যেন দেশ ও মাটির স্মৃতি আগলে বসে থাকে পুরনো মানুষরা। তাঁদের গায়ে লেগে আছে হাতপাখার বাতাস, আর হ্যারিকেনের আলো মাখা তাঁদের সন্ধ্যাগুলোয় মিলেমিশে আছে ভেজামাটির গন্ধ। মাটির যত্ন না নিলে আমাদের পায়ের তলার মাটিও যে একদিন সরে যাবে, মাটির জন্য নির্ধারিত দিনে সেই কথাটিই আর একবার মনে করা তাই জরুরি।