দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, রঞ্জনা ভট্টাচার্য -এর গল্প হলুদ সুড়ঙ্গ। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় চৈতালি বক্সী
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
মাথায় স্টিলের মগটা দিয়ে মেয়ে আঘাত করার পর প্রহ্লাদ মাথাটা ধরে বসে পড়ল। মিনতি ছিটকে পড়ে আছে। হাতের শাঁখা দু-টুকরো। শুভা চোখের সামনে দেখছে মগ দিয়ে মেরে ও বাবার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
দেখছে…মগটা হাতে নিয়ে দেখেই যাচ্ছে বাবা মাকে মেরে মাটিতে ফেলে দিল। হাতের শাখা চুরমার হয়ে গেল। মগটা ওর হাতেই রয়ে গেছে ,ওর বাবা আস্ত মাথা নিয়ে গালাগালি করতে করতে বেরিয়ে গেল। এরকমই হয় শুভার।ভাবে যে কাজটা করছে , কিন্তু আসলে করে উঠতে পারে না। দিন আনি-দিন খাই পরিবারে অশান্তি লেগেই থাকে।সরকারি পাঁচশো টাকা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের কাছ থেকে মারপিট করে টাকাটা কেড়ে নিয়ে বাবা চুল্লুর ঠেকে চলে যায়। শুভা প্রতিবারই ভাবে বাবাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবে। কিন্তু,কখনই পারে না। ছোট বেলা থেকে পড়াশোনাটা মাথায় খুব একটা ঢুকতো না। কিন্তু, যেটা ও খুব সহজেই পারত তা হল কারুর বাড়ি গিয়ে চোখের নিমেষে ওর পছন্দের জিনিসটি নিয়ে আসা।আজ অবধি কোনোদিন ধরা পড়েনি। ওর ভীষণ সরল দুটো চোখ, নরম হাসি কিছুতেই ওকে সন্দেহ তালিকায় রাখতে দেয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের খেলনা, হাতঘড়ি, সোনার দুল যাই এনেছে ,তাই প্রথমে একটু বকাঝকা করে মা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। হাতঘড়িটা ওর বাবা কেড়েকুড়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে , তারপর চুল্লু খেয়ে চুলের মুঠি ধরে মাকে মারতে শুরু করেছে। সেদিন মাও ধাক্কা দিয়ে বাবাকে ফেলে বলে উঠেছিল,’মেয়ের চুরি করা মাল বিক্রি করে মদ খেতে লজ্জা করে না?’
ওর বাবা চিৎকার করে বলেছিল, ‘করে না। তোর মত গতরখাকীর পয়সায় যার ভাত খেতে লজ্জা নেই,তার আবার কিসের লজ্জা?’
‘মুটেগিরি কর, দুটো মাল কিনে বিক্রি কর। ঘরের মাগ-বাচ্চা খেতে দিতে পারে না।বড় বড় কথা।‘এই বলে শুভাকেও একটা ঠাস করে চড় কষিয়ে দিল ওর মা। ওদের বাড়িটা জ্বলন্ত অঙ্গারের মত সর্বদা তেতে রয়েছে। ওর মায়ের প্রায়ই কাজ কামাই যায় অশান্তিতে।তাই কাজ ও থাকে না ঠিক মতো।
শুভার খুব কষ্ট হয় যখন মা অবধি ওকে চোর ভাবে। বোঝাতে পারে না যে ও চুরি করে না। জিনিসগুলো ওকে এমনভাবে ডাকে যে ও তাদের না নিয়ে পারে না।এই তো সেদিন একটা খুব সুন্দর পাথরের নেকলেস ওর চোখের সামনে রেখে চলে গেছিল নতুন বৌ।ওর মায়ের সঙ্গে রান্নার কাজে হেল্পারী করতে গেছিল সেখানে। কিন্তু,ও কি তুলেছিল নেকলেসটা? মোটেও ওটা ওকে ডাকে নি।তাই ওটা ও ছুঁয়েও দেখে নি। যে জিনিসটা ওকে হাতছানি দেয়, সেই জিনিসটাই ওর হাতে আসে। যেহেতু বস্তুটির ওর উপর সমান আকর্ষণ তাই ওর কাছেই ওরা থেকে যায় এবং ধরাও পরে না। বাবা যখন কেড়ে জিনিসগুলো ওর কাছ থেকে নিয়ে যায়,ও বুঝতে পারে জিনিসগুলো ওর জন্য কান্নাকাটি করছে।
নিভৃতি লবণের বাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।শেষ কক্ষের একটি ইলেকট্রন বীর্যের মতো ক্লোরিনকে দিয়ে দেয় সোডিয়াম, তাদের নতুন সন্তান হয় লবণ।সোডিয়াম ক্লোরাইড।যা ছাড়া কোনো কিছুই স্বাদু হয় না। নিভৃতি ধাতু না অধাতু…ও তো ইলেকট্রন দিতেও পারবে না,নিতেও পারবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে থেকে বের হয়ে এল। একটু হাওয়ার জন্য ব্যালকনিতে গিয়ে ও দাঁড়ালো। ওখান থেকেই শুভাকে যেতে দেখে ডাক দিল নিভৃতি। শুভা উপরে এসে বললো,’ডাকছিলেন ?’
নিভৃতি ওর কোমল মুখটাতে হাত বুলিয়ে বললো,’আগেও তো আমার মা থাকতে তোর মায়ের সঙ্গে এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে দিতিস।তোর কাজে খুব যত্ন।কাল আমার ছুটি আছে।একটু আসবি? ঘরগুলো একটু পরিষ্কার করবো। পাঁচশো টাকা দেব আর দুপুরে আমার সাথেই ডাল ভাত যা হোক খেয়ে নিবি।‘ শুভা খুব খুশি হয়। অনেকদিন পর পেট ভরে খাবার লোভ টাকার থেকেও বেশি ওকে হাতছানি দেয়।
পরেরদিন সকাল সকাল নিভৃতি চিকেন কষা,ডাল, আলুভর্তা আর আমের চাটনি করে রাখে।
সাড়ে নয়টার মধ্যে শুভা চলে এল। আজ দুজনে মিলে বসে একসাথে টিফিন খেল ,চা খেল।খুব রোগা মেয়েটা ,পাখির মতো ছোটদুটো বুক তিরতির করছে।ঐদিকে একবার তাকিয়ে নিভৃতি মুখ ঘুরিয়ে নিল।সাড়ে দশটা থেকে প্রায় আড়াইটা বেজে গেল ঘর,দুয়ার পরিষ্কার করতে করতে। তারপর দুজনে স্নান করে খেতে বসলো।
খুব তৃপ্তি করে শুভা খাচ্ছে। নিভৃতি জিজ্ঞাসা করল,’আরেকটু চিকেন আর ভাত নে’
খুব সলজ্জ ভাবে মাথা নেড়ে শুভা সায় দিল।
খাবার পর মুখে পানমশলার সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে নিভৃতি ওর খুব কাছে এসে বসল।
শুভার একটা আঁকার খাতা আছে সেখানে ও লুকিয়ে লুকিয়ে আঁকে অনেকরকম রঙের সুড়ঙ্গ।আর প্রতিটি সুড়ঙ্গের শেষে একটি করে মৃত ঘোড়ার দেহ। সুড়ঙ্গের আলোর দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে শুভা খোলা তলোয়ার নিয়ে। এটা তার অশ্বমেধ যজ্ঞ। ঘোড়ার দেহটা অশ্বের মত হলেও মুখটা কোনো পুরুষের মুখ। কখনও সেটা সান্টাদার মুখ,যে সুযোগ পেলেই ওর বুকে হাত দিয়ে ব্যথা দেয়, কখনও পটলার যে জোর করে ওর জামা টেনে নামিয়ে দিয়েছিল, কখনও সেটা ওর বাবার মুখ,যে মাকে সকালে মারে আর রাতে মায়ের উপর মাটিতে চড়াও হয় । তখন বিছানার উপর ওরা তিনভাইবোন চুপ করে শুয়ে থাকে।ও আড়চোখে দেখেছে ভাইদের প্যান্টগুলো তাঁবুর মতো হয়ে যায়।ওর বমি পেতে থাকে, তবু ও চোখ খুলতে পারে না।
নিভৃতিদের বাড়ি প্রথম যেদিন গেছিল ওর মায়ের সঙ্গে, সেদিন ওর পিঠের সেফটিপিনটা হা করে খোলা ছিল। নিভৃতি ওর উদোম পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল,ওর কেমন যেন শিরশির করে উঠেছিল সারা শরীর।অন্যরকমের সুখ,যা ও পুরুষের স্পর্শে কোনোদিন পায়নি। খুব যত্ন করে সেফ্টিপিনটা আটকে দিতে দিতে নিভৃতি বলেছিল ‘তোর পিঠে খুব ময়লা। একদিন আসিস সাবান দিয়ে ঘষে দেব।‘তারপর কতদিন ওদের বাড়ির নিচে দিয়ে শুভা ব্যালকনির দিকে তাকাতে তাকাতে গেছে, কিন্তু,আর ডাকেনি ওকে।
আজকে শুভার মুখে নিভৃতির চুমুতে ভেজা পানমশলার গন্ধ। কিন্তু,ওর পিঠটা ময়লাই রয়ে গেছে। ওখানে যত্ন করে সাবান ঘষে দেয় নি কেউ। আজকে ও পাঁচশো টাকা পেয়েছে,পেট ভরে খাবার পেয়েছে, একটা নাইটি, পানমশলার গন্ধওয়ালা চুমু পেয়েছে; তবু কেন শুভার চোখে জল আসছে শুভা বুঝতে পারছে না,ওর ময়লা শিরদাঁড়াটা যেন আরও বেশি ময়লা মনে হচ্ছে।
জিনিসগুলো যেমন ওর দিকে চেয়ে আকুতি জানায়, আমাকে নাও…শুভাও তো সেভাবেই আকুতি জানিয়েছিল ওর নরম দুটো চোখ দিয়ে, বলেছিল, ‘তোমার কাছে থাকি? তোমার সব কাজ করে দেব।‘একটা সিগারেট ধরিয়ে নিভৃতি বলেছিল, ‘তা হয় না। আমার এক পার্টনার আছে।ও তোর থাকা পছন্দ করবে না। তাছাড়া মাসে একটা কাজের লোক পোষার মত পয়সা আমার নেই। ছোটখাটো চাকরি করি…’- বলে গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে দিল। ‘মাঝে মাঝে ডাকলে আসিস। ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করব একসাথে…’বলে একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। শুভার কানের কাছে বেজে চললো,’কাজের লোক…’ – ও দেখলো একটা কাচের ময়ূর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ময়ূরটা নিভৃতির চোখের সামনেই তুলে আছাড় মেরে ভেঙে বেরিয়ে এল। নিভৃতি হতভম্ব।
কিছুদূর এলোমেলো হেঁটে, একটা দোকানে দেখতে পেল সেই মগটার মতোই একটা নতুন মগ যেটা দিয়ে শুভা ওর বাবাকে মারতে চেয়েছিল। নগদ টাকা দিয়ে মগটা কিনে শক্ত করে ধরে শুভা বাড়ির দিকে এগোতে থাকল, কানে বাজছে মায়ের চিৎকার।
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: