ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছোটবেলা,
দূরের বালুকাভূমি থেকে আগাছা ডিঙিয়ে, অনেকটা পথ হেঁটে, নদীর সাঁকো পেরিয়ে তোমার ওদিকে মাঝেমধ্যে যাই। বড় অচেনা লাগে। আড়িয়াদহ বাংলা স্কুল থেকে হেমা জেলের বাড়ির দিকে সরে এলে, সেই লেদ কারখানার পাশে অন্ধকার মাঠ। দূর থেকে পায়েসের চালের গন্ধ আসত। ছাতিম ছিল একটা। কাশীনাথের ছাদের নীলচে আকাশপ্রদীপের আলোয় মিশে যেত সেই গন্ধ। মনে আছে? তখনও হেমন্ত কাল ছিল। হিম-ভরা নিস্তব্ধ সন্ধ্যাগুলো থমথমে হয়ে থাকত। চটকলের ভোঁ বাজত রাত ৯টায়। থেমে থেমে বাতাস কাঁপত। তারপরই ঝুপ করে রাত নেমে পড়ত। হেমন্তের ভিজে তারারা ছাদে নামত। গুঁড়ি গুঁড়ি আলোর কণার মতো হিম। জোনাকি রং জানলায় কত অন্ধকার ছিল। সাদা ফ্যাটফ্যাটে ব্রয়লার মুরগির মতো আলো এখন।
গাঙ্গুলি পুকুরে নোনাধরা ঘাটের কাছে আরও একটা ছাতিম ছিল। ঝেঁপে ফুল হত। এখন আর এ তল্লাটে একটাও ছাতিম নেই বুঝলে। হেমা জেলেদের পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট উঠেছে। গরমের দুপুরে বড় বড় কাতলা ভেসে উঠেই ডুবে যেত কেমন। রুনুকাকাদের ক্লাবটাও নেই। সাড়ে চারটের রোদ কার্নিশ ছুঁলেই সরু কচি গলায় শোনা যেত, রেডি সেডি অনিমা গো। “রেডি স্টেডি অন ইয়োর মার্ক গো।” অনিমা যে কে কেউ জানত না! ‘রেডি সেডি’ বলতে বলতেই আমরা কবে স্টেডি হয়ে গেলাম।
নেড়াকে মনে আছে তোমার? লুকোচুরি বিকেলগুলো?
সেই ঘুপচি মিটারবক্সের তলা, সিঁড়ির তলা, ঝুলমাখা সোঁদা গন্ধ চিলছাদের ঘর? ওসব আর নেই। ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।
বাতাবিলেবু তলায় ভীম যুধিষ্ঠিরদের টালি চালের ঘরটা নেই। পার্টি অফিস হয়েছে। ‘এক্কাদোক্কা’, ‘চোঠো’ এসব আর কেউ খেলে না। সেই একটা করে ঘর কেনা, আর হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে সে ঘর ধুয়ে মুছে একাকার। দমকা বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁটে বাঁশের গোলায় বালির পাহাড় থেকে ঝুরঝুরে বালি উড়ত। বাঁশের গাদার ওপর শুয়ে থাকত নন্টে। তুমিই একমাত্র জানতে ওই ছেলেমানুষি প্রেমের কথা। দীপক ইলেকট্রিকের নন্টে। সিলিং ফ্যান রং করত। জ্যৈষ্ঠের দুপুরে হঠাৎ মহালয়া চলত দীপক ইলেকট্রিকে আর পাড়ার উঠতি মিঠুন নন্টে পাখা রং করত। ক্লাস সেভেনে ওকেই বিয়ে করব ভেবেছিলাম, নাইনে উঠে আর কথা বলিনি।
তুমিও চলে গেলে বড় তাড়াতাড়ি মায়াময় বিকেলগুলো সঙ্গে নিয়ে। সেদিন রাস্তায় দেখি একটা মেয়েকে তার মা বকতে বকতে যাচ্ছে। “ব্যাডমিন্টন খেলো, সাঁতারটা শেখো, ক্যারাটে প্র্যাকটিস করো, কিছু তো করো সলিড, বেকার সময় নষ্ট।” আমার তো সাঁতার, জিমন্যাস্টিকস, হারমোনিয়াম কিছুই শেখা হল না। তোমার দীর্ঘ দারুণ দিনগুলোর ওপর দিয়ে অকারণ সময় বিপুলা নদীর মতো বয়ে গেছে। আর সেই অসান্য মায়াবী দিনগুলোর আলো ছায়ার উৎসব রেখে গেছে।
সূর্য নামা মাঠের শেষে বিকেল চলে যাচ্ছে সন্ধের হাত ধরে, দাদন কাকাদের চা দোকানে হ্যারিকেন জ্বলে উঠল, পুঁটির বাবা লম্ফ জ্বালিয়ে বিশাল কালো আলুর চপের কড়াই চাপিয়েছে- এসব দেখতেই তো তোমার কাছে আসি। জানোই তো আমার সলিড কিছু হয়নি। প্রতিবেশী খেলুড়ে, পাড়া-বন্ধুদের তুচ্ছ ধুলোভরা মেলামেশায় আমাদের হৃদয়গুলো একান্ত লোভনীয় হয়ে রইল। রেডি স্টেডি হল না, আর অনিমারা তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।
প্রায়ই জ্বর হয়। আর ধীরে ধীরে চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসে। বিছানার ওপারটা কতদূরের নদী পারের দেশ। ঝাপসা ধোঁয়াশা জল ছুঁয়ে বেঁকে চলে গেছে ছোটবেলার দেশে। সেই দেশ থেকে পাঁচিল ডিঙিয়ে কত কিছু যে আসে। দাদন কাকাকে দেখি মাঝেমধ্যে লাঠি হাতে তেড়ে মাচা ফাংশানের রাতে। “দো ঘুট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি”-র মাঝখানে মারপিট হুজ্জোত লাগবেই বসার জায়গা নিয়ে। দো নয়, পুরো বোতল পিকে পাবলিক তখন জোজোর গানে উন্মত্ত।
দাদন কাকা আর নেই জানো তো? রুনু কাকাদের ক্লাবের সরস্বতী ঠাকুর আনতে গিয়ে আটচাকা ট্রাকের তলায়।
জ্বরের সময় মাথার মধ্যে গুমখুন মার্কা রুদ্ধশ্বাস ঘোর। চারপাশে সান্নাটা। উফঃ খামোশি! বিছানার ওধারটা ফাঁকা বালির চর। কাশডাঁটার ফুটো ঘরে শুয়ে আছি। নিঃসীম ঠান্ডা! হোক তা। এই বরফের ঠান্ডা বেয়েই তো ছোটবেলা তুমি আস। আমার পুরোনো দিনগুলো মমতাময় বিভ্রম নিয়ে আমায় দ্যাখে। স্তব্ধ সবুজ কচুরিপানায় ঢাকা গাঙ্গুলিপুকুরের জল। ওপারে বয়েজ স্কুলের মাঠে ছেলেদের হুল্লোড়। কচুরিপানার নৌকা চেপে লগিতে জল ঠেলে আমরা যেতাম ওই পারে। ভীম যুধিষ্ঠির, ঝুনি, মিতুল। বহুদিন দেখি না ওদের। তাই তো লোভে লোভে আসি তোমার কাছে ওদের খুঁজতে।
ভীম রিকশা চালাত পরের দিকে, মাটির মূর্তি গড়ার হাত ছিল। যুধিষ্ঠির প্রথমে সাইকেল দিয়ে শুরু করে পরে মোবাইল চোর হয়েছিল। মার্ডার হয়ে গেল। প্লাস্টিক ঢাকা বডি এল অনেক রাতে। পানা কচুরির নৌকার দুর্দান্ত নাবিক, তাদের উজ্জ্বল মুখ মনে পড়ে।
অথৈ মেঘ ঢুঁড়ে এলেও তারা অধরা। অন্য জগতে চলে গেছ তুমি ছেলেবেলা। রূঢ় পাহাড়ের ভাঙা পাথরের খাঁজে কচি চারায় তোমায় বাঁচিয়ে যাই।
এ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছবে হয়তো কোনও শ্রাবণের মেঘগহিন বিকেলবেলা। আমি তখন বড়বেলায় মন খারাপ করা বিকেলে। কোথাও গান হচ্ছে, এ দোস্তি হাম নেহি…।
ছোটবেলা, আমি আর কত দূর যেতে পারি বলো তোমার সঙ্গে।