ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
ছেলেবেলা,
যতই বয়েস বাড়ছে, ততই কারণে-অকারণে মনে পড়ে যাচ্ছে তোর কথা। কেমন চারধারে অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে আমরা বড় হয়েছি, বল। সেটা এই ভিড়ের ট্রেন ধরে, অজস্র হর্নের আওয়াজে ব্যতিব্যস্ত শহরের পথ ধরে বাড়ি ফেরার সময়, বড্ড বেশি করে মনে পড়ে।
কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম জানিস, আমাদের ছোটবেলার সেই প্রিয় জায়গায়। ভাবছিলাম, যদি হঠাৎ করেই তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! কিন্তু দেখা মিলল না। জায়গাটা একেবারেই পাল্টে গিয়েছে। অনেক কোয়ার্টারে মানুষজন নেই, অনেকগুলো ভাঙা পড়েছে। মনটা খুব অশান্ত লাগছিল।
আমাদের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে একটুখানি এগিয়েই যে ছোট্ট স্কুল– সেটা সেইরকম-ই রয়েছে। আমাদের সময় সেখানে ছেলে-মেয়ে, বাংলা-হিন্দি– সব মিলিয়ে একটাই সেকশন। স্কুল শুরু হওয়ার আগে হত প্রার্থনা। জাতীয় সঙ্গীত নয়, তবুও শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। কিন্তু তার অর্থটা যে কী– এই নিয়ে তখন-ই কোনও প্রশ্ন জাগেনি, এখন আর ভেবে কী হবে? একটুখানি আগে স্কুলে পৌঁছে গেলে, কোথা থেকে ঠিক জোগাড় হয়ে যেত গুলি-ডান্ডা। একবার কেমন চোখে লেগে গিয়েছিল আমার, মনে আছে?
অথবা স্কুলের ঘাস উঠে যাওয়া মাঠে দাগ কেটে ‘গাদি’। প্রার্থনার ঘণ্টা না পড়লে, সে খেলা থামতেই চাইত না। প্রার্থনার লাইন থেকেই শুরু হতো খুনসুটি, চুল-টানা, আলতো চাঁটি। সেটা লুকিয়ে চুরিয়ে চলত ক্লাসেও। একটুখানি বড় হলে চলত খাতার পাতায় গোল্লা আর কাটাকুটি খেলা। তখনই দেখেছি, ধরা পড়লে বা পড়া না পারলেও মেয়েদের গায়ে কেউ হাত তোলেন না। কিন্তু ছেলেদের রেহাই নেই। অপরাধ বেশি হলে মারতে মারতে ছড়িই ভেঙে যেত, এক-একদিন। আরও বড় হলে চেষ্টা করতাম মার খেয়েও চিৎকার না করা, কান্না তো নয়ই। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা– সে বড় কঠিন কাজ।
মনে আছে, সকালে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে কেমন ফুলের সাজি হাতে বেরিয়ে পড়তাম? ফুলের গাছ তখন প্রায় সব কোয়ার্টারেই। তিন-চারটে জায়গায় গেলেই সাজি ভর্তি হয়ে যায়। তাই সেদিকে আমরা যেতাম না। স্রেফ ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম এদিক ওদিক। পাড়ার মোড়ে একটা বিশাল মহুয়া গাছ। গরমের শুরুতে তলায় ভর্তি হয়ে পড়ে থাকত মহুয়া ফুল। সেই গাছটা এখন আর নেই। এইসময়েই ফুটে উঠত পলাশ– আশেপাশের ছোটখাটো পাহাড় আলো করে। তবে এইসব ফুল তো পুজোয় লাগে না। পলাশের পাতা মুড়ে সত্যনারায়ণ পুজোর সিন্নি খেয়েছি অবশ্য অনেক। জানি না, এখন হয়তো ওখানেও থার্মোকলের প্লেট আর বাটি ব্যবহার করা হয়।
বিকেলে নিজের সমবয়সীদের সঙ্গে চলে যেতাম, যে যার খেলার মাঠে। ক্রিকেট খেলা হলে যতজন জুটেছি, ততগুলো ছোট ছোট দাগ কেটে কেউ একজন লটারি করতো। একটা দাগ পছন্দ করলেই ব্যাট চাপা মাটিতে উঁকি দিয়ে বলত– চার বা সাত। এই নম্বর অনুযায়ী ব্যাট করতে সুযোগ পাবে সে। কখনও বড়দের খেলা দেখতাম মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে। ফুটবলে কাকে বলে থ্রু-পাস, কাকে সোয়ার্ভিং কিক, কাকে বলে অফসাইড– সব এখান থেকেই শেখা।
সন্ধ্যায় খোলা বই সামনে রেখে ভাবতাম আমি নেমে পড়েছি ওই মাঠে। দারুণ কাটালাম পরপর দু’জনকে, তারপর কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে মাথা ছুঁইয়ে কাঁপিয়ে দিলাম জাল! বড় হয়ে যখন এই দাদাদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেলাম, তখন আমাদের আগ্রহের জল অনেক দূরে গড়িয়েছে। তখন পড়ার বইয়ের মাঝে লুকিয়ে ঠাঁই নিয়েছে স্বপনকুমার। বাড়িতে না বলে বন্ধুদের সঙ্গে চলে যাচ্ছি নদীতে– স্নান করতে। নদীর পাড়ে, পাহাড়ের গায়ে প্রচুর কুল গাছ– শীতকালে কতরকম যে কুল! লাল রঙের বুনোকুল পেড়ে পাশের বাড়ির দিদিদের পৌঁছে দিলে, বিকেলে খেলতে যাওয়ার আগে ওদের আড্ডার জায়গা ঘুরে যাওয়াই ছিল দস্তুর। নুনঝাল দিয়ে মাখা সেই কুল ওরা দিত পলাশ পাতায়। সেটা চাটতে চাটতে আমরা পৌঁছে যেতাম খেলার মাঠে। জল-ঝড় কোনও কিছুই আমাদের খেলতে যাওয়া থেকে আটকাতে পারেনি, ঠিক কিনা?
দেখেছিস তো, ওই মাঠের দু’পাশেই রাস্তা। খেলাধূলা চলতে চলতেই রাস্তায় মেয়েদের হাঁটাহাঁটি শুরু হয়ে যেত। ওদের হাসির আওয়াজ আমাদের কানে আসত। কারোর কারোর দৌড় তখন হালকা হয়ে যেত, কারোর পাশ দিয়ে বল গলে চলে গেলে তাকে খেপে গিয়ে গালাগাল দিত অন্যরা। কেউ কেউ আবার তাকে কেউ দেখছে বলে নিঃসন্দেহ হয়ে, একেবারে তেড়েফুঁড়ে উঠে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিত। এরমধ্যেই শোনা যেত, অমুক দাদা নাকি তমুক দিদিকে একটা ফুল দিয়েছে। খেলা শেষ হলে, সমবয়সীরা গোল হয়ে বসে এইসব নিয়ে তুমুল আলোচনা করতাম। খেলার মাঠ থেকে বাড়ি ফিরতে তাই দেরি হয়ে যেত মাঝে মাঝেই।
ক্লাস টেনে উঠে শুভমিতার দিয়ে যাওয়া খাতায় একদিন আবিষ্কার করেছিলাম কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি। সেটা দেখে তখন আমার পাগল-পাগল অবস্থা। এলোমেলো ভাবে সেগুলো নাড়াচাড়া করেছিলাম অনেকক্ষণ। কাউকে বলতেও পারিনি, এবার আমার কী করা উচিত। তারপর একসময় খাতাটা ফেরত দিয়ে দিই, ওই সমস্ত পাপড়ি সমেত। এখন খুব আফসোস হয়। আবার যদি তোর কাছে ফিরে যেতে পারি, কয়েকটা কি কথা বলতাম ওকে? কে জানে! তারপর ওই জায়গাটা ছেড়ে এসে আর বড় একটা যোগাযোগ নেই কারো সঙ্গে। গোলাপের গন্ধটুকু শুধু রয়ে গেছে আমার সঙ্গে– আজীবন।
তাই বলি, আমার কাছে তুই এভাবেই থাকিস। আমার সব দুষ্টুমি, সব বোকামি আর সব হেরে যাওয়াকে জড়িয়ে ধরে। সেদিনের সেই কষ্ট পাওয়াগুলোও এখন খুব মধুর লাগে। মনে মনে এখনও তোর কাছেই ফিরে যাই, কোনও নির্জন দুপুরে, কোনও বিষন্ন বিকেলে অথবা কোনও মনখারাপ করা সন্ধ্যায়। আমার এই ভুলে ভরা জীবনসাগরে তোর দিকেই আমি তাকিয়ে দেখি– আমার আদরের লাইটহাউস। আমাকে যেন কখনই ছেড়ে চলে যাস না।