এ কথা ঠিক যে, এই সঙ্গীত পরিচালকের থেকে আরও বহু স্মরণীয় কাজ পেয়েছেন ভারতীয় শ্রোতারা। তাঁর ঘরানার সঙ্গীতের থেকে ‘নাটু নাটু’ যে বেশ আলাদা তা-ও স্বীকার্য। আবার, ব্যক্তিগত রুচি নিয়েও কোনও কথা চলে না। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ভাল লাগার নিরিখে যদি একটি সংস্কৃতিকে খারিজ করতে হয়, তবে সেই রুচি কিন্তু প্রশ্নের মুখেই পড়ে। আলোচনায় চৈতালী বক্সী।
চন্দ্র বোসের লেখা এবং এম এম কিরাবাণীর সুরারোপিত যে গান অস্কার জিতল, সেই গানকে আমরা ভারতীয়রা কতজন ভাল ভাবে নিতে পেরেছি? গোটা ভারতের কথা বাদ দিয়ে যদি বাংলার কথা বলি তাহলেও কিন্তু প্রশ্নটা একই থেকে যায়।
আরও শুনুন: ‘নাটু নাটু’ কি শুধু নাচের গান! অস্কার জয়ের পর আসল অর্থ খুঁজছে দেশবাসী
বিশ্বের দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে ‘আরআরআর’ সিনেমাটি। সিনেমার পরিচালক, সুরকার, হিরোদের মতো সিনেমার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি কলাকুশলী আজ গর্বিত। আর তাছাড়া ভারতবাসী হিসেবে আমরাও গর্বিত। অস্কার হাতে নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমেই চন্দ্র বোস জানিয়েছেন ‘আমি এই মুহূর্তে ভাবছি যে, কখন দেশে ফিরব আর এটা সবাইকে দেখাব?’ সুতরাং তাঁরাও জানেন যে তাঁর দেশ, দেশের মানুষ অপেক্ষা করে রয়েছে বিজয়ীদের ফেরার। যেমন ৮৩-র বিশ্ব জয়ের পর কপিলদেব ও দলের বিশ্বকাপ হাতে, ঘরে ফেরার অপেক্ষা করছিলাম আমরা। কিন্তু সত্যিই কি তাই!
আরও শুনুন: অস্কারজয়ী সঙ্গীত পরিচালক কিরাবাণীর আছে আরও তিন নাম, দেখুন তো চেনেন কি না?
গানের কথা বা সুর আমাদের কতজনের ভাল লেগেছে? আর ভাল না লাগার বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বহুজন সোচ্চারও হয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ‘নাটু নাটু’র মতো একটা গান কী করে অস্কার জিততে পারে? গানটি ‘ওভারেটেড’, এই গানের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় গানও রয়েছে, সেগুলিকে কেন পুরস্কার দেওয়া হল না? ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব এই গানে নেই- এরকমই সমালোচনা ধেয়ে এসেছে অস্কারজয়ী সংগীতের দিকে।
প্রথমত, আমরা অনেকেই হয়ত তেলুগু ভাষার নাটু নাটু গানটির অনুবাদ গান হিন্দি বা অন্য ভাষায় শুনে ভাল মন্দের বিচার করে ফেলেছি। কিন্তু অনুবাদে অনেক সময়ই সেই রস থাকে না যা মূল ভাষায় থাকে। গানের কথার সঙ্গে জীবনের কোনও ঘটনা, কোনও মানুষ, এমন কিছুকে জুড়তে না পারলে, সে গান অতটা মনে সাড়া জাগায় না আমাদের। রবি ঠাকুরের গানের ক্ষেত্রে যেমন অনেকেই বলেন, এইমাত্র আমার জন্য, আমার বর্তমান মনের অবস্থা ভেবেই যেন লিখে দিয়েছিলেন, তাই এত বুকে বাজে, মনে ঢেউ তোলে সে গান। অস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে, গানটির গীতিকার কানুকুন্তলা সুভাষ চন্দ্র বোসও, অনেকটা তেমনই কথা বলেন নিজের মাতৃভাষা নিয়ে। বলেন, ‘তেলুগু একটি সুরেলা ভাষা, তেলুগু ভাষার কোনও সাধারণ শব্দও সুরের মত শোনায়, আরআরআরের এই গান তাই তেলুগু জানা মানুষরা খুবই পছন্দ হয়েছে’।
আরও শুনুন: এই প্রথম অস্কারের আসরে মালালা, বিতর্ক এড়িয়ে দিলেন শান্তির বার্তা
আর যাঁরা ভাষা জানেন না, তাঁরা এর সুর পছন্দ করবেন এমনটা আশা ছিল, কিন্তু সেক্ষেত্রে দেশের মানুষদের মধ্যেই দেখা গেল মতপার্থক্য। গানটির সুরকার স্বনামধন্য এমএম কিরাবাণীর বা এমএম ক্রিমের বক্তব্য এর উত্তর হিসেবে রাখতে পারি আমরা। তিনি বলছেন, ‘গানের ৬/৮ ছন্দ দক্ষিণ ভারতের সাথে জুড়ে রয়েছে, পশ্চিমের দেশগুলি তো দূর, ভারতের উত্তর অংশেও এই ছন্দে গান খুব একটা দেখা যায় না।’ সেই কারণেই হয়তো দক্ষিণ ভারত বাদে (উত্তর বা পূর্ব ভারতের বিশেষ করে) বাকি ভারতের অনেক অংশেই তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি গানটি। সেখানে মানুষজনের মনে হয়েছে গানটি ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। কিন্তু আসমুদ্র-হিমাচল এই দেশের সংস্কৃতির কতটা খোঁজ রাখেন তাঁরা, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। তবে আফ্রিকার গানেও ৬/৮ ছন্দ খুবই পরিচিত। তাঁর ওপর এই গানে ৬/৮ ছন্দ বিট পার মিনিট বা (BPM) বদল করে একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে, যা পশ্চিমের দেশগুলিতে একেবারেই শোনা যায় না। সুরকারের বক্তব্য, এটাই হয়ত বিচারকদের কানে বেশি অন্যরকম, ‘অরিজিনাল’ লেগেছে। আর তাই নাটু নাটু গানের জন্য সেরা অরিজিনাল সং বিভাগে সেরার খেতাব এসেছে চন্দ্র বোস ও কিরাবাণীর ঘরে।
এ কথা ঠিক যে, এই সঙ্গীত পরিচালকের থেকে আরও বহু স্মরণীয় কাজ পেয়েছেন ভারতীয় শ্রোতারা। তাঁর ঘরানার সঙ্গীতের থেকে ‘নাটু নাটু’ যে বেশ আলাদা তা-ও স্বীকার্য। আবার, ব্যক্তিগত রুচি নিয়েও কোনও কথা চলে না। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ভাল লাগার নিরিখে যদি একটি সংস্কৃতিকে খারিজ করতে হয়, তবে সেই রুচি কিন্তু প্রশ্নের মুখেই পড়ে। সংস্কৃতির এই যে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র- তা গ্রহণের থেকেও কি বর্জনের দিকেই আমরা বেশি ঝুঁকি পড়েছি এই ব্যক্তিগত রুচির দোহাই দিয়ে! ‘নাটু নাটু’ কারও ভাল না লাগতেই পারে। তবে যে গান দেশের প্রতিনিধিত্ব করে বিশ্বের মঞ্চে সেরার স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনছে, তার ভিতরকার ঐশ্বর্যের প্রতি কেন আমরা মনযোগী হব না! কেন প্রাদেশিকতা আর ব্যক্তিগত রুচি সরিয়ে রেখে, আরও সমগ্রতা দিয়ে বিচার করব না শিল্পকে! ভারতের যে বৈচিত্র আত্মা সে তো গ্রহণের সংস্কৃতিকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই ‘নাটু নাটু’-কে খারাপ বলার আগে, বা খারিজ করার আগে, আমাদের সাংস্কৃতিক গ্রহণ-বর্জনের দিকটিকেও বোধহয়য় আরও একবার বিবেচনা করে দেখা উচিত। অন্তত সেই সময় এবার এসে গিয়েছে বলেই মনে হয়।