পায়েল হোক বা অন্যরা, সামাজিক অন্যায়, অসাংবিধানিক যে কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই তাঁরা গর্জে উঠেছেন। ফলত হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখেও পড়েছেন। তবে সেই বিক্ষোভ-বিদ্রোহই যে তাঁদের একমাত্র পরিচয় নয়, তা নিজেদের কাজ দিয়েই প্রমাণ করেছেন তাঁরা। এখনও করছেন। দেশবিরোধী বলে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগে সরগরম হয় দেশ, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁরাই স্বীকৃতি আদায় করছেন। মারের মুখের উপর দিয়েই যে সৃষ্টির ফুল ফোটানো যায়, প্রমাণ করে দিয়েছেন পায়েল ও তাঁর সতীর্থরা।
রোহিত ভেমুলার মৃত্যু থেকে সিএএ চালু করার সিদ্ধান্ত- অন্যায়, মানুষের স্বার্থবিরোধী যে কোনও ইস্যুতেই তাঁরা সরব হন। আর সে কারণে হিন্দুত্ববাদীদের কাছে সহজ টার্গেট হয়ে পড়েন তাঁরা। পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক সরবতা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের কেরিয়ারে ক্ষতির কারণও হয়ে উঠেছে। তবে দেখা যাচ্ছে, সে সব তাঁদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। বরং দেশের জন্য বিশ্বমঞ্চে স্বীকৃতি আদায়ে তাঁরাই এগিয়ে। সাম্প্রতিক কান-এ ভারতে জয়জয়কার সে কথাই মনে করিয়ে দিল।
পায়েল কাপাডিয়ার কথাই ধরা যাক না কেন! গ্রাঁ প্রি জিতে তিনি এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পরিচিত নাম। ভারতের গর্ব তো বটেই। সেই পায়েলই পড়ুয়া থাকাকালীন ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের মুখে পড়েছিলেন। সমস্যা হয়েছিল স্কলারশিপ নিয়েও। বছর নয়েক আগের ঘটনা। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল গজেন্দ্র চৌহানকে। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন পড়ুয়ারা। পায়েল সে সময় এফটিটিআই-তেই পড়াশোনা করছেন। সেদিনের ছাত্র আন্দোলনে তিনিও শামিল হন। ক্লাস বয়কট করে প্রায় চার মাস আন্দোলন চালান পড়ুয়ারা। ফলত তাঁর বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। সে বছরই আর একটি ইস্যুতে প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরকে ঘেরাও করেন পড়ুয়ারা। প্রায় ৩৫ জন পড়ুয়ার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছিল, তালিকায় ছিলেন পায়েলও। সেই পায়েলই আজ গোটা দেশকে গর্বিত করেছে কান-এর মঞ্চে। সন্দেহ নেই, তাঁর সতীর্থরা, যাঁরা এককালে কর্তৃপক্ষের রোষের মুখেপড়েছিলেন, তাঁদের সকলের জন্যই এই মুহূর্ত স্বস্তির। পায়েল ছাড়াও পুনে ফিল্ম ইন্সটিউটের আর-এক প্রাক্তনীও কান-এ এবার খেতাব অর্জন করেছেন। চিদানন্দ এস নায়েকের ছবি ‘সানফ্লাওয়ার্স ওয়্যার দি ফার্স্ট ওয়ানস্ টু নো’ (Sunflowers Were the First Ones to Know) জিতে নিয়েছ লা-সিনে অ্যাওয়ার্ড।
আরও শুনুন: বিশ্বে সেরা অভিনেত্রী অনসূয়া, ‘কান’-এর স্বীকৃতি আজও গর্বিত করে বাঙালিকে
অথচ এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদের রাজনৈতিক প্রতিরোধের কারণে প্রায়শই হেনস্তার শিকার হতে হয়। বেশিদূর পিছিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। চলতি বছরেই বাবরি ভাঙা অসাংবিধানিক দাবি করে একটি ব্যানার দিয়েছিলেন পড়ুয়ারা। তা নিয়ে রীতিমতো সংঘর্ষ বেধে যায় হিন্দুত্ববাদী এক গোষ্ঠীর সঙ্গে। অভিযোগ ওঠে যে, হিন্দুত্ববাদীরা ক্যাম্পাসে ঢুকে ওই ব্যানার পুড়িয়ে দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ মোতায়েন করতে হয়। তদন্তে উঠে আসে, ‘হিন্দুবান্ধব সামাজিক সংস্থা’র নাম। কিন্তু এই ঘটনায় পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সাত পড়ুয়াকেও অভিযুক্ত করা হয়। সে সময় ছাত্র সংগঠনের অভিযোগ ছিল যে, আক্রমণের ঘটনাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না প্রশাসন। মুক্তচিন্তা এবং বাকস্বাধীনতায় আঘাত হানার অভিযোগ বারবারই করেছেন পড়ুয়ারা। তাঁদেরও নানা হেনস্তার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে, প্রতিবাদের পথ তিনি ছাড়েননি। পায়েল হোক বা অন্যরা, সামাজিক অন্যায়, অসাংবিধানিক যে কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই তাঁরা গর্জে উঠেছেন। ফলত হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখেও পড়েছেন। তবে সেই বিক্ষোভ-বিদ্রোহই যে তাঁদের একমাত্র পরিচয় নয়, তা নিজেদের কাজ দিয়েই প্রমাণ করেছেন তাঁরা। এখনও করছেন। দেশবিরোধী বলে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগে সরগরম হয় দেশ, দেশের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁরাই স্বীকৃতি আদায় করছেন। মারের মুখের উপর দিয়েই যে সৃষ্টির ফুল ফোটানো যায়, প্রমাণ করে দিয়েছেন পায়েল ও তাঁর সতীর্থরা।