দীর্ঘ দুশো বছরের পরাধীনতার শেষে নতুন দিনের ভোর। এত রক্ত, এত যন্ত্রণা পেরিয়ে সত্যি হতে চলেছিল এতদিনের অপেক্ষা। তবু ১৫ আগস্ট যেন স্বাধীনতা না দেওয়া হয় ভারতকে, এই মর্মে একাধিক আবেদন গিয়েছিল উপরমহলের কাছে। কিন্তু কেন? বিশেষ এই দিনটিকে ঘিরে ঠিক কী সমস্যা হয়েছিল? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
একদিকে গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলন। আরেকদিকে নেতাজি-মাস্টারদা-বাঘা যতীন প্রমুখের নেতৃত্বে রক্তঝরা লড়াই। দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। শেষমেশ ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্স অ্যাটলি ঘোষণা করলেন, ১৯৪৮ সালের ৩০ জুন স্বাধীনতা পাবে ভারত। আর এই স্বাধীনতা দানের প্রক্রিয়া কার্যকর করার ভার পড়ল ভারতের শেষ ভাইসরয়, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের উপর। ‘৪৭-এর মার্চ মাসেই ভারতের দায়িত্ব নিলেন তিনি। আর নিয়েই বুঝলেন, আদৌ এতদিন সময় নেই তাঁর হাতে। কারণ ততদিনে জাতীয় কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের ভেতরে ভেতরে বিরোধ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশকে দুভাগ করে ফেলার পক্ষে মত দিচ্ছেন অনেক নেতা-ই। আর তার ছোঁয়াচ লেগেছে জনতার মধ্যেও। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতির ভেদাভেদ সত্ত্বেও এতদিন যে বিশাল ভূখণ্ড এক হয়ে ছিল, সেখানে তখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ধুয়ো উঠেছে। দেশভাগের জল্পনা ছড়াতে না ছড়াতেই দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবর আসতে শুরু করে। এই অবস্থায় মাউন্টব্যাটেন হিংসা পরিস্থিতিকে আর বাড়তে দিতে চাননি, এমনটাই জানিয়েছেন স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। আর সেই কারণেই ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনক্ষণ এক বছর এগিয়ে আনা হয়। জওহরলাল নেহেরু আর মহম্মদ আলি জিন্না, উভয়ের উপস্থিতিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ১৫ আগস্ট তারিখেই স্বাধীনতা পাবে ভারত। যে দিনটি স্থির করেছিলেন মাউন্টব্যাটেন নিজেই।
আরও শুনুন: পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিচ্ছেন ভারতীয়রা! ইঙ্গিত মিলছে তথ্যে, কারণটা কী?
কিন্তু এই বিশেষ দিনটি নিয়ে ঘোরতর আপত্তি দেখা দিল দেশজুড়ে। বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, এতদিনের পরাধীনতা আরও এক বা একাধিক দিন বাড়লেও আপত্তি নেই। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনটি যেন কোনওমতেই ১৫ আগস্ট না হয়। এর যুক্তি হিসেবে তাঁরা জানিয়েছিলেন, জ্যোতিষ গণনা করে দেখা যাচ্ছে, ওই বিশেষ দিন এবং বিশেষ ক্ষণটি, অর্থাৎ ১৫ আগস্টের মধ্যরাত ভারতের পক্ষে অশুভ। এমনকি খোদ লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লিখে কলকাতার এক জ্যোতিষী মদমানন্দ জানান, মকর রাশির সঙ্গে রাহু, কেতু এবং শনির যোগ রয়েছে এই দিন। এই অশুভ ক্ষণে খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা। সুতরাং নতুন একটি দেশের জন্ম কখনোই এমন দিনে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। জানা যায়, কেবল তিনি একাই নন, সারা ভারতের জ্যোতিষীদের গণনাই প্রায় একই কথা বলেছিল।
আরও শুনুন: জ্ঞানের পথে বাধা নয় ধর্ম, রামায়ণ নিয়ে কুইজে সেরার খেতাব দুই মুসলিম পড়ুয়ার
কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন মাউন্টব্যাটেন। কারণ জ্যোতিষীদের গণনায় যে দিনটি অশুভ, সেই একই দিনটি যে তাঁর কাছে অত্যন্ত পয়মন্ত। পরে নিজের আত্মজীবনী ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’-এ তিনি জানিয়েছিলেন, দু’বছর আগে এই বিশেষ তারিখটিতেই মিত্রশক্তির কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল জাপান। আসলে ৬ ও ৯ আগস্ট পরপর দুটি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর হার মেনেছিল জাপান। আর তার ফলেই কার্যত শেষ হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের এক ভয়ংকর অধ্যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মাউন্টব্যাটেন। সেই কারণেই এই দিনটিকে ভারতকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। ক্ষমতা ছাড়ার আগে পর্যন্ত হয়তো ব্রিটিশ রাজশক্তি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল, পরাধীন দেশ হোক কি মানুষ, নির্বাচনের অধিকার পায় না কেউই। আর তাই, সব আপত্তি, অনুরোধ, আবেদন নিবেদন উড়িয়ে, ১৫ আগস্টেই স্বাধীনতা পেয়েছিল ভারত।