যে শিল্পীর কনসার্ট ঘোষণা মাত্র একটা গোটা প্রজন্ম উদ্বেল হয়ে পড়ে, সেই মানুষটি যে ঠিক কতটা জনপ্রিয়, কতটা ভালোবাসার মানুষ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অনেক শিল্পীই জনপ্রিয়তা পান। তবে কেকে-র জনপ্রিয়তা যেন ছুঁতে পেরেছিল অনেকগুলো প্রজন্মকে। তাই অগণন সংগীতপ্রেমী মেনে নিতে পারছে না তাঁর আকস্মিক চলে যাওয়া। এই জনপ্রিয়তা অবশ্য একদিনে পাননি কেকে। অনেক স্ট্রাগল করেই ছুঁতে পেরেছিলেন শ্রোতার হৃদয়। আসুন শুনে নিই, তাঁর জীবনসংগ্রামের কিছু অজানা গল্প।
ছিল না সংগীতের কোনও প্রথাগত তালিম, ছিল না মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে তথাকথিত কোনও গডফাদার; ছিল বলতে শুধু মনের অদম্য ইচ্ছে আর ভগবান প্রদত্ত কণ্ঠস্বর। কেকে-র জীবনের শুরুটাও ছিল আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতোই। কলেজে পড়াকালীন প্রধান গায়ক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ‘হরাইজন’ নামে এক ব্যান্ডে। লক্ষ্য একটাই, নিজেদের সেরাটা দিয়ে উৎকর্ষের শীর্ষ ছোঁয়া। সতীর্থ গৌতম চিকারমানে সেই সব দিনের স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একসময় তাঁরা বিভিন্ন কলেজের ফেস্টে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। উদ্দেশ্য ছিল, সেখানে প্রতিযোগিতায় জিতে কিছু টাকা রোজগার করা। একবার সিরি ফোর্টস অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান করে কেকে আর তাঁর ব্যান্ড পেয়েছিল ৫০০০ টাকা। সেকালে তার মূল্য ছিল অনেক। এই অর্থ পেয়ে নিজেদের তাই যেন রাজা ভাবতেন তাঁরা। সেই শুরুর মাইলস্টোন থেকে জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত ডেস্টিনেশানে পৌঁছানোর জার্নিটা অবশ্য সহজ ছিল না। নেপথ্যে থেকে গিয়েছে অনেক ঘাম আর শ্রমের গল্প।
আরও শুনুন: তোমায় হৃদমাঝারে রাখব… কয়েক প্রজন্মের গুমরে ওঠা কান্নার নাম KK
জীবনের শুরুর এই সময়টায় কেকে সম্মুখীন হয়েছিলেন বেশ কঠিন পরিস্থিতির। অর্থের প্রয়োজনে, এক সময় বিক্রি করতে হয়েছিল নিজের টাইপরাইটারটিকেও। ততদিনে শুধু গান গাইবেন বলেই কেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন সেলসের চাকরি। কিন্তু গান গাইব বললেই তো আর গাওয়া যায় না! বহু আকাঙ্ক্ষিত সুযোগ সহজে করায়ত্ত হয় না। গানের নেশায় পাগল হয়ে এক সময় কেকে শুরু করেছিলেন বিভিন্ন হোটেলে গান গাওয়া। কিন্তু বারবার আক্ষেপ করে বলতেন, এই পরিবেশ তাঁর মোটেই ভালো লাগে না। মানুষ তাঁর গান শুনছেন খেতে খেতে কিংবা পান করার সময়; গানের প্রতি এই ধরনের মনোভাব একেবারেই পছন্দ ছিল না তাঁর। তবু উপায় না দেখে, সেই কাজও করতে হয়েছিল কেকে-কে।
আরও শুনুন: দুর্ভাগা সেই দেশ… সম্প্রীতির প্রয়োজনে শিল্পীর বন্ধুতাও যেখানে মাপা হয় ধর্মের পরিচয়ে
এমনভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায়। একদিন সেসব ছেড়েছুড়ে কেকে রওনা দিয়েছিলেন স্বপ্ননগরী মুম্বাইয়ের উদ্দেশে। বাণিজ্যিক সংগীতের জগতে পা দিয়েছিলেন লুইস ব্যাংকস, রণজিত বারোট ও লেসলি লুইসের হাত ধরে। এরপর ডাক পান ইউটিভি-র পক্ষ থেকে এবং সেখানেই শুরু করেন জিংগল গাওয়া। ১১-টিরও বেশি ভাষায় প্রায় ৩৫০০ জিংগল গেয়েছিলেন কেকে। পরবর্তীকালে কাজ করেছেন আর ডি বর্মণ, এ আর রহমান-সহ প্রায় সব বিখ্যাত সংগীত পরিচালকের সঙ্গে। ‘মাচিস’ ছবির সেই বিখ্যাত ‘ছোড় আয়ে হাম’-এর শুরু অংশে কেকে-র কণ্ঠ মাতিয়ে দিয়েছিল সংগীত অনুরাগীদের। কেকে ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন কয়েক প্রজন্মের সংগীতের নিজস্ব ভাষা।
জীবনের শেষ দিনেও গানে গানেই মাতিয়ে রাখলেন তাঁর অনুরাগীদের। একজন সার্থক শিল্পীর যে ভূমিকা, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কেকে তাই-ই পালন করেছিলেন নিষ্ঠাভরে। আর তাই আগামীতেও সংগীতপ্রেমীরা মনে রাখবেন তাঁকে, তাঁর গানকে, মনে রাখবেন একজন সত্যিকার সুরসাধককে।