সংসদীয় রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক অভিষেক হল প্রিয়াঙ্কার। টিকালো নাক, সেই ইন্দিরা ছাঁট, পরিপাটি শাড়ি। তাঁকে দেখে অনেকেই বলেন, ইন্দিরা 2.0; চেহারাগত সাদৃশ্য এতটাই যে এ তুলনা টানা অস্বাভাবিক নয়। তবে, ইন্দিরার মতো দেখতে হওয়া আর ইন্দিরা হয়ে-ওঠার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।
ইন্দিরা আছেন প্রিয়াঙ্কায়, প্রিয়াঙ্কা কি পৌঁছতে পারবেন ইন্দিরায়?
ভারতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন এলোমেলো ঘুরতে থাকা প্রশ্নটি এতদিনে যেন ধ্রুবপদ পেয়ে গেল। সংসদীয় রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক অভিষেক হল প্রিয়াঙ্কার। এই দেশ, এই দেশের রাজনীতি, তার ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে তিনি অপরিচিত নন মোটেই। ভারতীয় রাজনীতির যে নেহরু-ঘরানা, তার উত্তরসূরি তিনি। তবে সার্থক উত্তরসূরি কি-না, সেই অ্যাসিড টেস্ট শুরু হয়ে গেল এবার।
টিকালো নাক, সেই ইন্দিরা ছাঁট, পরিপাটি শাড়ি। তাঁকে দেখে অনেকেই বলেন, ইন্দিরা 2.0; চেহারাগত সাদৃশ্য এতটাই যে এ তুলনা টানা অস্বাভাবিক নয়। তবে, ইন্দিরার মতো দেখতে হওয়া আর ইন্দিরা হয়ে-ওঠার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। সে-কথা সকলেই জানেন, প্রিয়াঙ্কা নিজেও। তিনি নিজে তাই এ-তুলনায় স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। এবং তিনি জানেন গত এক দশকে ‘নেপোটিজম’ এবং ‘পরিবারবাদ’ শব্দদুটিকে যেভাবে ঘষেমেজে রাজনৈতিক করে তোলা হয়েছে, তাতে এ-তুলনা বিপজ্জনকও বটে। স্ট্যান্ড-আপ কমেডির দুনিয়ায় ইতিমধ্যে এ নিয়ে দু-পশলা মশকরা চলতেই থাকে।
প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক অভিজ্ঞান কী? না, তিনি ইন্দিরার মতো দেখতে।
অথচ সরাসরি তিনি রাজনীতিতে আসেন না। আছেন, অথচ নেই। রাহুল গান্ধীকে রাজনীতির উচ্চকিত ভাষ্য ততদিনে ‘পাপ্পু’ আখ্যা দিয়ে দিয়েছে। কংগ্রেসের অন্দরে কেবলই হাহুতাশ। আর সেই হাওয়ায় কেবলই ভেসে বেড়ায় দীর্ঘশ্বাস, যদি প্রিয়াঙ্কা রাজনীতিতে আসতেন! যদি আর একবার ভারতীয় রাজনীতি ইন্দিরার মেজাজ পেত! তবু রাজি হতেন না প্রিয়াঙ্কা। ঠিক তাঁর ঠাকুমার মতোই। ‘৫২ সালে ভোটে লড়তে চাননি ইন্দিরা, কেননা দুই ছেলেই তখন বেশ ছোট। প্রিয়াঙ্কাকেও যতবার ভোটের ময়দানে নামতে বলা হয়েছে, ততবার তিনি পরিবারের কথা বলেছেন। তাঁরও দুই সন্তান বেশ ছোট। আর এই মিল খুঁজে পেয়ে সেই দীর্ঘশ্বাস আর একটু দীর্ঘ হয়ে মথিত হয়ে উঠত এই ভেবে যে, এত যখন মিল, তাহলে প্রিয়াঙ্কা ইন্দিরা হয়ে উঠছেন না কেন?
ঠাকুমা ইন্দিরা কিন্তু আশাবাদী ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রিয়াঙ্কাই আগামী দিনে তাঁর লিগ্যাসি বয়ে নিয়ে যাবেন। হয়তো ছোট্ট প্রিয়াঙ্কাকে দেখে তুখোড় রাজনীতিবিদ কিছু অনুমান করেছিলেন। তখন ইন্দিরা জেলে। ‘৭৭ সাল, ক্ষমতায় জনতা পার্টি। ইন্দিরা ঠিক করেছিলেন, বাড়ির আনা খাবার ছাড়া কণামাত্র মুখে দেবেন না। সোনিয়া গান্ধী, সেসময় ইন্দিরার জন্য রোজ খাবার নিয়ে যেতেন, আর সঙ্গে থাকতেন হয় রাহুল নয় প্রিয়াঙ্কা। ঠাকুমাকে চোখের দেখা দেখা-ই শুধু উদ্দেশ্য ছিল না। বরং দু’জনের ক্ষেত্রেই তা ছিল রাজনৈতিক ক্লাস। যে-পরিবার থেকে তাঁরা এসেছেন, যে-রাজনীতির তাঁরা অংশ, তার একদম হাতেকলমে শিক্ষা। রাহুল পেয়েছিলেন, প্রিয়াঙ্কাও। কেউ কেউ ভাবেন, রাজনীতিতে আসার জন্য রাজনৈতিক পাঠের দরকার নেই। যেহেতু সকলেই রাজনীতিতে আসতে পারেন আর সফল হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু এটাও ঠিক যে, রাজনৈতিক পরিবেশ না পেলে রাজনীতির মন ও মনন তৈরি হয় না। প্রিয়াঙ্কার ক্ষেত্রে সেই কাজের সূচনা ছোটবেলা থেকেই।
যত বড় হয়েছেন, ঠাকুমার সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্যের কথা যত শুনেছেন, প্রিয়াঙ্কা ভিতরে ভিতরে নিশ্চয়ই রাজনীতির জন্য তৈরিও হয়েছিলেন। তবে সময় নিচ্ছিলেন। ঘনিষ্ঠ নেতার কাছে তাঁর ঠাকুমা বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন প্রিয়াঙ্কার মধ্যে ইন্দিরাকে দেখবেন মানুষ। তখন আর ইন্দিরাকে মনে রাখার প্রয়োজন হবে না। এতবড় কথা যাঁর রাজনীতির ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তিনি যে নিজেকে আবিষ্কারে সময় নেবেন, তা সঙ্গত। অথচ ১৯৯৮ সালে মায়ের সঙ্গে যখন গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রাজনৈতিক মঞ্চে, প্রথমবার বলেছিলেন- আপনারা সকলে কংগ্রেসকে ভোট দেবেন- আর জনতা উদ্বেল হয়ে উঠেছিল- সেই প্রতিক্রিয়ায় ছাব্বিশের তরুণীর মাথা ঘুরে যাওয়ারই যেন কথা ছিল। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা ধৈর্য ধরে প্রমাণ করলেন, তিনি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, ইন্দিরার নাতনি। রাজনীতির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে তবেই তিনি ময়দানে নামবেন। নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রথম পরিচয় বোধহয় এই সিদ্ধান্তেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা।
এর মধ্যে গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জলই গড়িয়েছে, বদল এসেছে ভারতীয় রাজনীতিতে। সরাসরি ভোটের রাজনীতিতে যোগ না দিলেও, প্রিয়াঙ্কা অরাজনৈতিক নন কোনওভাবেই। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বিরোধী রাজনীতির অবস্থান থেকে তিনি কখনোই হাততালি কুড়নো রাজনীতির কথা বলেননি। ব্যক্তি-আক্রমণের সহজ রাস্তা ধরেননি। দেশে বর্তমান যে শাসনব্যবস্থা চলছে, সেই ব্যবস্থা বা তন্ত্রের মৌলিক বিপদগুলো চিহ্নিত করেছেন। সেই বিপদের আগুনে কারা হাওয়া দিচ্ছেন তাঁদের চিনিয়েছেন। আর সেই সবটার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। একইসঙ্গে প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক বক্তব্যে, তাঁর ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে এরকমটা হয়। এক-একটি ঘরানায় প্রশিক্ষিত শিল্পী সেই ঘরানার চিহ্নসমূহ কণ্ঠে ধারণ করেন। প্রিয়াঙ্কাও নেহরু-ইন্দিরা ঘরানার রাজনৈতিক স্বর আয়ত্ত করেছেন। এবং বিভিন্ন বক্তব্যে ক্রমশ মনে করিয়ে দিয়েছেন সেই কথা। মনে করিয়ে দিয়েছেন, দেশ কী ছিল, আর কী হয়েছে। মনে করিয়ে দিয়েছেন, দেশের কোথায় যাওয়ার ছিল, আর কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। সন্দেহ নেই, রাজনৈতিক স্থিতধী প্রিয়াঙ্কা আটঘাট বেঁধেই ময়দানে নেমেছেন। আর তাই তড়িঘড়ি জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা তিনি করেননি। তাতে শাপে বর হয়েছে। তার দেশ পুনরুদ্ধারের কথা তাঁকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। ফলস্বরূপ এবার তিনি সংসদে, ভারতীয় রাজনীতির একেবারে মূলস্রোতে।
প্রিয়াঙ্কা জানেন, তাঁর কাছে প্রত্যাশা অনেক। দলের এবং দেশের। এমন এক সময়ে তিনি রাজনীতির মূল সিঁড়িতে পা রাখলেন, যখন নেহরুভিয়ান রাজনীতির দর্শন পুনরুদ্ধার করা সহজ নয়। দেশ বদলেছে, সময় বদলেছে, বদলে গিয়েছে গোটা বিশ্বের পরিস্থিতিও। অর্থাৎ একটি ঘরানা থেকে এলেও, প্রিয়াঙ্কাকে নতুন রাজনৈতিক ভাষ্যই খুঁজে পেতে হবে। নইলে যা হবে, তা গতানুগতিক। ভোটে হারা-জেতার খেলা। সেই খেলাটুকুর জন্যই যে তাঁকে কেউ দ্বিতীয়া ইন্দিরা ভাবতে চাইছেন, তা নিশ্চিত নয়। হারা-জেতার বাইরে, রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বা দর্শন পালটে দেওয়ার যোগ্যতা যাঁদের থাকে, তাঁদের নামেই এক-একটি সময় চিহ্নিত হয়। ইন্দিরার আশা ছিল, প্রিয়াঙ্কার নামেও সেভাবে আগামী সময় সূচিত হবে। আর প্রিয়াঙ্কার সামনে চ্যালেঞ্জ বোধহয় অবিকল ইন্দিরা না হয়ে ওঠা। একই সঙ্গে মোকাবিলা করা তাঁর বিরোধীদের। পাশাপাশি করতে হবে দল গুছিয়ে তোলার কাজ। কারণ দলের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দিতে না পারলে, দেশের বদল বা দেশের ধারণার পুনরুদ্ধার কোনোটিই সম্ভব নয়।
অতএব সবদিক থেকে একরকমের ‘গৃহিণীপনা’র প্রত্যাশা প্রিয়াঙ্কার কাছে। শব্দটিতে নতুন অর্থ সংযোজন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভাষা এবং প্রকৃতির ‘গৃহিণীপনা’ বলে তিনি এমন একটা গুণের কথা বলতে চাইছিলেন, যে গুণে সবকিছু পরিপাটি করে রাখা যায়। প্রয়োজনমতো উপস্থিত বুদ্ধির জেরে এমন পদক্ষেপ করা, যাতে বৃহত্তর অর্থে সংসারের চাকা সচল থাকে। ইন্দিরা থেকে ইন্ডিয়া, ঘর গুছিয়ে বাইরে সামলানোর এই গৃহিণীপনার অপেক্ষাতেই যেন দেশের রাজনীতি।
প্রিয়াঙ্কা কি তা পারবেন? দেশের রাজনীতির মতো প্রিয়াঙ্কা নিজেও জানেন, এই উত্তর তাঁকে খুঁজে পেতে হবে অচিরেই।