তিনি মঞ্চের আন্তিগোনে। তিনি রুপালি পর্দার বিমলা। তাঁর অভিনয় মুগ্ধ করে রেখেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। তিনি স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। এই পৃথিবী ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছেন না-ফেরার দেশে। থেকে গিয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় কাজ। বাঙালির স্মৃতিতে আজও যা অমলিন। কিংবদন্তি অভিনেত্রীর স্মৃতিচারণায় সোহিনী সেনগুপ্ত, দেবশঙ্কর হালদার। শুনলেন, শ্যামশ্রী সাহা।
বাংলা নাট্যমঞ্চকে নিঃস্ব করে চলে গিয়েছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। মঞ্চে আর তিনি এসে দাঁড়াবেন না কোনও চরিত্র হয়ে। আর তাঁর মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়বে না গোটা প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে। এই শূন্যতা যে কতখানি, তা বাংলা থিয়েটারের দর্শকমাত্রই জানেন। ‘আন্তিগোনে’ থেকে ‘অজ্ঞাতবাস’, বাঙালিকে যে কতখানি অভিনয় বৈচিত্রে ভরিয়ে রেখেছিলেন স্বাতীলেখা, তা নিশ্চিতই স্মরণ করবে আগামী প্রজন্ম।
তবে থিয়েটারের শূন্যতার পাশাপাশি এক আত্মিক শূন্যতার অনুভবও জেগে উঠেছে। তাঁর পরিজন অনুভব করছেন সেই শূন্যতা। তাঁদের স্মৃতিতে জেগে আছেন বিদুষী এক মহিলা। স্বাতীলেখার কন্যা সোহিনী জানান কেমন ছিলেন তাঁর মা। বলেন, ‘পুতুল নয়, মায়ের দেওয়া প্রথম উপহার ছিল বই। আর কিনে দিতেন ব্লকস। খুব ছোট বয়স থেকেই মা অভ্যাস করিয়েছিলেন বইপড়া আর সিনেমা দেখার। মাঝে মাঝেই বেড়াতে নিয়ে যেতেন মিউজিয়ামে। চিড়িয়াখানায় বন্দি পশুপাখিদের দেখে কষ্ট পেতেন মা। খুব ছোট বয়স থেকেই উপার্জন করার ইচ্ছা মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন স্বাবলম্বী হতে। ‘
স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত মানেই সত্যজিতের বিমলা। স্বাতীলেখা স্মরণে বাঙালির মনে এই কথাটাই যেন প্রথমে চলে আসে। সেবার ‘সীমাবদ্ধ’-র শুটিং শেষ করেছেন সত্যজিৎ, মাথায় ঘুরছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’। এই উপন্যাসকে তিনি ধরতে চান চলমান চিত্রমালায়। কিন্তু বিমলা চরিত্রের জন্য কিছুতেই অভিনেত্রী খুঁজে পাচ্ছেন না। একদিন গিয়েছেন নাটক দেখতে। সেদিন মঞ্চে নতুন এক অভিনেত্রীকে দেখে সত্যজিতের চোখে খুশির ঝলক। মাথায় খেলে গেল বিদ্যুৎ।
মগজে বিমলা চরিত্রের যে খসড়া করেছিলেন, একেবারে হুবহু মিলে যাচ্ছে। মঞ্চে যিনি দাপিয়ে অভিনয় করছেন এঁকেই বিমলা হিসেবে মানাবে। খোঁজ নিয়ে সত্যজিৎ জানলেন, এই অভিনেত্রী চমৎকার পিয়ানো বাজাতে পারেন। গানের গলাটিও বেশ। তিনিই হলেন রুপোলি পর্দার বিমলা। স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।
এরকম একজন বিদুষী অভিনেত্রীকে খুব কাছ থেকেই দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। তাঁকে পেয়েছেন বন্ধু হিসেবে, পেয়েছেন অভিভাবক হিসেবেও। আবার তাঁর কাছে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভয়ও পেয়েছিলেন বেজায়। সে গল্পই শোনালেন দেবশঙ্কর। বললেন, ‘অসামান্য সুন্দরী, বিদুষী, কিংবদন্তি শিল্পীকে সামনে দেখে ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল। এর মধ্যেই শুরু হল পরীক্ষাপর্ব। প্রস্তুত ছিলেন না একেবারেই। সামনে তখন পরীক্ষক হিসাবে উপস্থিত স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল।’
দেবশঙ্কর হালদারের নান্দীকার-এর প্রথম দিনটা ছিল এরকমই। পরীক্ষাপর্ব শেষ হওয়ার পর আবিষ্কার করেছিলেন সহজ-সরল, আকর্ষণীয় একজন মানুষকে। এরপর কেটে গিয়েছে চৌত্রিশ বছর। সেদিনের পরীক্ষক স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ক্রমশ হয়ে উঠেছেন সহ-অভিনেতা, কখনও নির্দেশক। ওঁর কাছে অভিনয় শিখেছেন, কখনও মঞ্চের বাইরে আবার কখনও মঞ্চে অভিনয় চলাকালীন। স্বাতীলেখার অভিনয় ছিল সহজ, সাবলীল, অন্তর্ভেদী। তার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ছিল মেধা, প্রজ্ঞা, ঐতিহ্য ও আধুনিকতা। চরিত্রের অন্তরে ডুবে যেতে পারতেন খুব সহজেই। ওঁর আবেগ, বুদ্ধি, মাপ, ছিল নিখুঁত। সময়ের সঙ্গে হাত ধরে চলতে পারতেন। থিয়েটার ছাড়াও নতুন নতুন দিগন্ত আবিষ্কারের নেশা ছিল ওঁর। ভালবাসতেন দেশি-বিদেশি রান্না করতে, খাওয়াতে। দেবশঙ্কর ভালবাসেন তেলাপিয়া মাছ। বিভিন্ন পদের মতো তেলাপিয়া মাছও রান্না করতে ভুলতেন না। যাকে পছন্দ করতে না, ব্যবহারে বুঝিয়ে দিতেন। নিজের প্রতি ছিল অগাধ আস্থা। চলচ্চিত্রে, নাট্যে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত উদাহরণ হয়ে থেকে যাবেন অনন্তকাল।
নিজে যেমন স্বাধীনচেতা মহিলা ছিলেন স্বাতীলেখা, চেয়েছিলেন তাঁর সন্তানও যেন সেরকমই হয়ে ওঠেন। সোহিনী স্মৃতিচারণ করেন, ‘নিজে সিদ্ধান্ত নিতে শিখিয়েছিলেন। যে কোনও বিষয়ে নিয়ে বাড়িতে আলোচনা হত, ছোট-বড় সবার মত শোনা হত। এখান থেকেই ছোটদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে যেত। একমাত্র স্বপ্ন ছিল ‘নান্দীকার’। মা শিখিয়েছেন পরিশ্রমী ও পাংচুয়াল হতে। সত্যজিৎ রায় একবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন ‘ঘরে-বাইরে’ ছবি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে। সেদিন বন্ধ ছিল। স্বাতীলেখা সেদিন বিবেকানন্দ রোড থেকে বিশপ লেফ্রয় রোড হেঁটে গিয়েছিলেন। পৌঁছেছিলেন নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে। এই নিয়মানুবর্তিতাই ছাত্র-ছাত্রীদেরও শেখাতে চান সোহিনী।’
অভিনয়ে হোক বা ব্যক্তিত্বে – স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত তাঁর আপন স্বাতন্ত্রে ভাস্বর। থিয়েটার বেঁচে থাকে স্মৃতি ও শ্রুতিতে। থিয়েটারপ্রেমী বাঙালির মন থেকে তিনি কখনও মুছে যাবেন না। থেকে যাবে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি যে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন তাও পরম্পরাবাহিত হয়ে পৌঁছে যাবে উত্তরপ্রজন্মের কাছে। বাঙালির মনের আকাশে স্বাতী নক্ষত্রের স্নিগ্ধ আলোর মতোই থেকে যাবেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।