কবিতার গুলজারকে কথায় পাওয়া তো কম কথা নয়! গুলজার-সান্নিধ্য পাওয়া জীবনের বিরলতম মুহূর্তগুলির মধ্যেই একটি। জনাকয় সাক্ষাৎকারপ্রত্যাশীর দলে ভিড়ে সেই অভূতপূর্বের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব হয়েছিল। এক জীবনের বুকপকেটে যত্নে তুলে রাখা সেই হিরে-মানিক মুহূর্ত।
ফিরে দখলেন, সরোজ দরবার।
কবিতা তো আর স্ন্যাক্স নয়!
স্বভাবসিদ্ধ মৃদুভাষে বলে উঠলেন তিনি। সেই শ্বেতশুভ্র পরিধান। মায়াবী চোখের দৃষ্টি যেন দূরে কোথাও। ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসির রেখা। কবিতা শোনানোর অনুরোধে যখন এ-কথা বললেন, তখন হাতে-গোনা মাত্র কয়েকজনই সেখানে। সকলেই সামান্য দ্বিধায় পড়ে গিয়েছেন ততক্ষণে। দেখে, ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে তিনি আর-একটু যোগ করলেন,- আসলে কবিতা এরকম নয়, যে, বৃষ্টি পড়ল আর পকোড়া এসে গেল।
বলে তিনি নিঃশব্দ। ঠিক যেন তাঁর বিখ্যাত ‘ত্রিবেণী’ পর্যায়ের কবিতার দু-পঙক্তি শেষের আশ্চর্য নীরবতা। যেন যা বলা গেল, বলা হল তার থেকেও বেশি কিছু। অনুক্ত সেই শব্দমালার অর্থ বাঙ্ময় হয়ে তৈরি করে দিচ্ছে এক সামগ্রিক অনুভব। যে-অর্থ প্রায় অতলস্পর্শী। কবিরা পারেন এইভাবে অনুচ্চারণকে উচ্চারণ করে তুলতে। সেদিন উপস্থিত সকলেই তা লহমায় বুঝে নিলেন। বুঝলেন, শব্দ যাঁর কাছে ঈশ্বর কবিতা তাঁর কাছে সাধনা। কবিতার কাছে যাওয়া-আসার পথ তাই সহজ নয়।
মৃদুভাসে গুলজার সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ইচ্ছামাত্রই কবিতা ‘পারফর্মিং’-এর মঞ্চে উঠতে পারে না। শুধু কি কবিতা? যে-কোনও শিল্পের জন্যই তো সে-কথা প্রযোজ্য। শিল্পের দিকে শিল্পীর যে গভীর-গোপন চলা, যে নিবিড় সখ্য, তার নাগাল পাওয়া সাধারণের কথা নয়। তখনই কথা ওঠে পারফর্মেন্সের ভিতর থেকে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার। গুলজার যেন সেদিন এর বিপরীত প্রক্রিয়ার অনুশীলনের কথাটাই নীরবতার ভিতর দিয়ে সোচ্চার করে তুলেছিলেন। যে ধ্যানের ভিতর দিয়ে কবিতার দেখা পান একজন কবি, সেই একই ধ্যানের ভিতর যদি পাঠক নিজে মেলে না দেন, তাহলে কবিতা ধরা দেয় কী করে! এ-এক রেওয়াজ, এ-ও এক সাধনা। বোঝালেন তিনি বোঝালেন।
-: আরও শুনুন :-
গুলজার-সান্নিধ্য পাওয়া জীবনের বিরলতম মুহূর্তগুলির মধ্যেই একটি। জনাকয় সাক্ষাৎকারপ্রত্যাশীর দলে ভিড়ে সেই অভূতপূর্বের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব হয়েছিল। তাঁকে দেখে তো বিস্ময়ের ঘোর লেগে যায়। অবিশ্বাস্য সব গান, অভাবিত শব্দমালা যাঁর ভাবনাগহন থেকে উঠে এসেছে, তিনি সামনে বসে আছেন! বিশ্বাস করতে করতেই কয়েক মূহূর্ত পৃথিবীর ঘড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়। তাঁকে আগে দেখেছি। ন্যাশনাল লাইব্রেরির অনুষ্ঠানে, কবিতা পড়তে। স্বকীয় তাঁর কবিতাপাঠের ধরন। প্রতি পঙক্তির ভিতরে শ্রোতাকে টেনে এনে ফুটিয়ে তোলেন এক-একটা দৃশ্যকল্প। মনে হয়, যেন শব্দের পানসিতে করে দৃশ্যের দেশে ঘুরিয়ে আনছেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে তিনি যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন স্বাভাবিক ভাবেই উৎসাহী-অনুরাগীর ভিড়। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সেদিন দেখলাম, সমূহ আগ্রহের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে যেন তিনি এক খণ্ড শরতের মেঘের মতোই মিলিয়ে গেলে দূরে কোথাও, দূরে দূরে। হয়তো ছবি এবং কবিতায় গড়া তাঁর নিজস্ব অনুভবের দেশে।
তার বছর কয়েক পর এবার দেখার সৌভাগ্য আর একটু কাছাকাছি। কেজো প্রয়োজন এটুকুই যে, একটি বিশেষ উদ্যোগের জন্য আমরা তাঁর সাক্ষাৎকার চাইছি। তিনি সাক্ষাৎকার দেবেন না, তা নয়; তবে সেখানে প্রযুক্তির যে ব্যবহার করা হচ্ছিল, তাতে তিনি রাজি নন। তাহলে? ফিরে আসা ছাড়া আর গতি নেই। আর তখনই তিনি স্বয়ং মশগুল হলেন গল্পে। ‘আশ্চর্য’ বিশেষণও বোধহয় যথোপযুক্ত নয়। প্রথাগত সাক্ষাৎকারে মত না থাক, সাক্ষাতে-আলাপে তাঁর আপত্তি নেই। অতএব চলে যেতে তো বললেনই না, বরং সকলকে বসিয়ে নিজে থেকেই নানা প্রসঙ্গে গল্প করতে শুরু করলেন। আর কী করে যেন সেই গল্পের ভিতরে চলে এল কবিতা-প্রসঙ্গ। না এসেই বা থাকে কী করে! শব্দের গেরস্থালী যাঁর আজীবনের, তিনি শব্দের ‘মেহক’ আর কতক্ষণই বা লুকিয়ে রাখবেন! গল্পের অনেকাংশ জুড়ে ছিল এই শব্দের অনুভব। শব্দের চলন, শব্দের ঐশ্বর্য; আবার কখনও শব্দকে যে রাজনীতির প্রয়োজনে খাঁচায় পুরে ফেলা হয়, শব্দের গোত্র বিচার করে তার সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়- সে সবই অবিরল বলে চলেছিলেন তিনি। উপস্থিত সকলেই তখন মন্ত্রমুগ্ধ। দু-এক কথার টুকরো সঙ্গত বাদ দিলে, সকলেই জীবনের বুকপকেটে যত্নে তুলে রাখছেন আচমকা পাওয়া আশ্চর্য মুহূর্তের হিরে-মানিক। কবিতার গুলজারকে কথায় পাওয়া তো কম কথা নয়!
কলকাতায় এসেছিলেন নির্ধারিত অনুষ্ঠানের সূচি নিয়ে। ফলত ইচ্ছে না করলেও উঠতে হয়। সেই সময়ই আতিথেয়তার দায়িত্বে ছিলেন যাঁরা, তাঁদের একজন কবিতা শোনার আবদার করে বসলেন গুলজারের কাছে। জবাবে তাঁর সেই মৃদু কথা- কবিতা তো আর স্ন্যাক্স নয়!
বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। কথাটি বারবার মনে পড়েছে। ঠিক তখনই, যখন অক্ষর থেকে মন অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যে কোনও সৃষ্টিই গভীর অভিনিবেশ দাবি করে। তার রসাস্বাদন করতে গেলে সৃষ্টির ভিতরমহলের সঙ্গে নৈকট্যের প্রয়োজন জরুরি। নইলে উপর-উপর এক রকমের অবলোকন হয় মাত্র। অথচ সময়টা তাৎক্ষণিক চাহিদাপূরণের। ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন আমরা যেন ইন্দ্রজাল চাইছি সকলেই। বুকারজয়ী গীতাঞ্জলী শ্রী দিনকয় আগে চমৎকার এক প্রসঙ্গ ধরিয়ে দিয়েছিলেন; একজন ডাক্তারের কদর করি এই জন্য যে, তিনি চট করে ভ্যাকসিন বানিয়ে দিতে পারেন। ইঞ্জিনিয়ার পারেন সেতু নির্মাণে। কিন্তু এমন প্রত্যাশা কি আমরা করতে পারি সাহিত্য বা সাহিত্যকের কাছে! যদি করে থাকি, তাহলে ভুল সেই গোড়াতেই। শিল্প,সাহিত্য আরও গভীর এবং আত্মিক যোগাযোগ প্রত্যাশা করে। যে গভীর এবং গোপন চলায় তাকে ছোঁয়া যায়, তাই-ই আসলে ঘনিয়ে তুলতে পারে বদল। সে চলন ধীর, সেখানে পরীক্ষা স্থৈর্যের। চটজলদির মায়াহরিণে তাকে স্পর্শ করা যায় না। ভাষা, সাহিত্যের ভিতরই নিজেকে, দেশকে, নিজের সময়কে আবিষ্কারের গুপ্তপথগুলো রাখা রাখে। গুলজার নিজে যেমন ভাষার এই ধর্মনিরপেক্ষ এবং কসমোপলিটন চরিত্রের কথা বলেওছেন অন্যত্র। যদি দেশকে চিনতে হয়, তাহলে দেশের বিভিন্ন ভাষার কবিতা তথা সাহিত্যের দিকেই তাকাতে হবে। ভাষার ভিতর দিয়ে যে স্বর উঠে আসছে, সেই বিভিন্নতাকে অনুধাবন করে যে স্বরসংগতিতে পৌঁছনো যায়, তাই-ই তো আত্ম-আবিষ্কার। মাত্রা, ছন্দ, তাল, লয়ের ঘেরাটোপে তাই শব্দ যেমন জলসাঘর নির্মাণ করতে পারে, তেমনই কবিতা হয়ে উঠতে শব্দের অবশ্যম্ভাবী মুক্তি। চিত্রপরিচালক, গীতিকার গুলজার আর কবি গুলজার তাই আক্ষরিক একজন হয়েও যেন আলাদা মানুষ। আর তাই কবিতা তথা শিল্পের প্রতি তিনি প্রত্যাশা করেন নিবিড় অভিনিবেশ, সমঝদারের আদর।
সময়টা গোলমেলে। মনযোগের আয়ু ক্রমশ কমছে আর কমছেই। আর তার ভিতর ক্রমশ বাড়ছে বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তির ভিতর শিল্প-সাহিত্য-কবিতা কি উপশম হয়ে উঠতে পারে? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, শিল্প-সাহিত্যের কাছে কি আমি যথার্থ ভাবে পৌঁছতে পারছি! আমার দুঃখ-সুখের গানে যিনি সুর দিচ্ছেন, আমি কি তার গান গাইছি? প্রশ্নের ছায়া অতিকায় হয়ে এসে পড়ে আমার বোধে। আমাদের বোধে। আর দেখি সে-প্রশ্নেরই অনতিদূরে দাঁড়িয়ে শ্বেতশুভ্র বসন পরিহিত এক শব্দসাধক মৃদুভাষে বলে উঠছেন- কবিতা তো আর স্ন্যাক্স নয়!