প্রথম একক গান গেয়েছিলেন বৃদ্ধ বাল্মীকির ভূমিকায়। নায়কের কণ্ঠে গান গাইতে বাধা পেয়েছেন বারে বারেই। তবু চ্যালেঞ্জের সামনে পিছু হটেননি মান্না দে। হাতিয়ার করেছেন তাঁর কণ্ঠ, তাঁর গায়কী, তাঁর এত বছরের সাধনা আর অধ্যবসায়কেই। আর তাই, তাঁর গোটা গায়কজীবনের সফর যেন একের পর এক চ্যালেঞ্জের পালটা জবাব। জন্মদিনে কিংবদন্তি গায়কের সেই যাপনকেই ফিরে দেখা, আরও একবার।
এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়/ সব সত্যি…
মান্না দে তাঁর সমস্ত জীবন যেন এই কথাটাই বারবার প্রমাণ করেছেন। তাঁর সঙ্গীত জগতে আসা এবং প্রথম রেকর্ডিং শুরু কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মাধ্যমেই। বৃদ্ধ বাল্মীকির চরিত্রের জন্য উদাত্ত গলার একজন প্লে ব্যাক গায়ক চাই। কৃষ্ণচন্দ্র তো অন্য কারও লিপে গাইবেন না। সুরকারকে তিনিই বলেন, ভাইপো মান্নাকে দিয়ে গাওয়াতে। কোনও দোটানা, ভয়, এতটুকু আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল না মান্না দে-র কণ্ঠে। যেন তিনি প্রথম দিন থেকেই জানতেন, সঙ্গীত জগতের তাবড় তাবড় রথী মহারথীর মাঝে তাঁকে এভাবেই নিজের জায়গা করে নিতে হবে। আর এই লড়াইয়ে তাঁর একমাত্র হাতিয়ার তাঁর কণ্ঠ, তাঁর গায়কী, তাঁর এত বছরের সাধনা আর অধ্যবসায়। এর কিছুকাল পরই ‘রামরাজ্য’ সিনেমার জন্য বৃদ্ধ অশীতিপর বাল্মীকির লিপে মান্না দে রেকর্ড করলেন তাঁর প্রথম একক গান।
আরও শুনুন: সুমন যেন অমোঘ সংক্রমণ, বাঙালিকে আধুনিক উচ্চারণে বলতে শেখালেন ‘তোমাকে চাই’
এরপর সিনেমার পার্শ্বচরিত্রদের লিপে প্লেব্যাকের কাজ পেতে শুরু করেন মান্না দে। মুকেশ, রফিদের মাঝে তিনি কিছুতেই যেন মূল অভিনেতার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারছিলেন না। আক্ষেপ করে বলতেন, সাধ করে কোনও বান্ধবী বা প্রিয়জনকে সেইসব রেকর্ডিং দেখাতে আনার সাহস নেই। এমনই সব পার্শ্বচরিত্রদের জন্য তাঁকে গান গাইতে হয়েছে যা লোক ডেকে দেখানোর মত নয়। খারাপ লাগত। দুঃখ হত। কিন্তু কখনোই তাঁর গানে সে প্রভাব পড়তে দেননি। যে সুরকার যেমন চেয়েছেন, তাঁর মত করে নিজের সেরাটা দিয়ে গেছেন। ফলে একসময় একটু চ্যালেঞ্জিং কোনও গান মানেই ডাক পড়ত মান্না দে-র।
এরপর আসে সেই দিন, যখন রাজ কাপুর তাঁর লিপে গান গাওয়ার জন্য বলেন মান্না দে কে। ছবির নাম – শ্রী ৪২০। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কোন গান – প্যার হুয়া একরার হুয়া। রাজ কাপুরের জন্য প্লেব্যাক সাধারণত মুকেশ করতেন। সেখানে রাজ কাপুরের মত একজন মান্না দে-কে তাঁর জন্য লিপ দিতে বলায় আনন্দে চোখে জল এসে গিয়েছিল মান্না দে-র। আর অন্যদিকে রাজ, রিহার্সালেই গান শুনে এত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে নার্গিসের হাত ধরে সেখানেই নাচতে শুরু করে দিয়েছিলেন।
আরও শুনুন: ‘নিজে ছবি ডিরেক্ট করছেন না কেন?’ সিনেমাপাড়ার তরুণকে পরিচালনায় আসার ডাক উত্তমকুমারের
তবে এরপরেও সমীকরণ বদলায়নি। ঠিক এর পরের রাজ কাপুরের ফিল্মেই একটা অত্যন্ত অপমানজনক ঘটনা ঘটেছিল মান্না দে-র সঙ্গে। তিনি গান রেকর্ড করার জন্য স্টুডিওতে হাজির। হঠাৎ ছবির প্রযোজক এসে তাঁর সামনেই বলতে থাকেন, এ কেন? অন্য কেউ নয় কেন? ছবির সুরকার শঙ্কর জয়কিষণ সেদিন তাঁর গানের জন্য মান্না দে-কে বেছেছিলেন। না, আর কাউকে পাওয়া যায়নি বলে নয়, তাঁর গানের জন্য মান্নার গায়কীই দরকার বলে। আর এরপর তৈরি হয় হিন্দি সিনেমার আরও এক কালজয়ী গান – ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’।
মান্না দে নিজের শহরেও খুব সহজে জায়গা পাননি। বাংলার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও ঘটেছে একই ঘটনা। বাংলা সিনেমার ডিস্ট্রিবিউটররা নাকচ করেছিলেন, নায়ক উত্তম কুমারের লিপে মান্না দে-কে দিয়ে গান গাওয়ানো যাবে না। শুনে সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত বললেন, বেশ। সিনেমায় উত্তম গাইবেন না, পার্শ্বচরিত্র গাইবে। তবে প্লেব্যাক মান্নাই করবেন। এতে সাপও মরল আর লাঠিও ভাঙল না। রাজের যেমন মুকেশ ছিলেন, উত্তমেরও ছিলেন হেমন্ত। তবে তারপরও উত্তম কুমারের লিপে মান্না দে-র গাওয়া, কাহারবা নয় দাদরা বাজাও থেকে কে প্রথম কাছে এসেছে, আজও আমাদের মন জুড়ে রয়েছে। আর এইভাবেই বাংলা আর হিন্দি সিনেমা, তথা গোটা ভারতীয় সিনেমার দুনিয়া জুড়েই এক চ্যালেঞ্জিং গানের সফর চালিয়ে গিয়েছেন মান্না দে। আজীবন।