বাঙালি মাত্রেই নাকি নেহাতই ভীতু। এই বাঙালিকে তাহলে কী বলবেন? যিনি খালি হাতে লড়াই করতেন বাঘের সঙ্গে। হিংস্র বন্য পশুর মুখোমুখি হতেও ভয় ছিল না, আবার শত্রুসেনার সামনে মরণপণ লড়াইয়েও তিনি অগ্রণী। কে এই বাঙালি পুরুষ?
যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতির সঙ্গে জুড়ে গেছে ভেতো আখ্যা। ভাত খেয়ে একটা লম্বা ঘুম- এই নাকি বেশিরভাগ বাঙালির দিনলিপি। শুধু কি ভেতো? সঙ্গে বড়োই ভীতু। কিন্তু সত্যিই কি তাই? উঁ-হুঁ! এই স্টিরিওটাইপকে ভাঙার জন্য একটি নামই যথেষ্ট। আর তিনি হলেন সুরেশ বিশ্বাস। নিশ্চয়ই কৌতূহলী হলেন। তাবড় তাবড় বাঙালি, যাঁদের নামের সঙ্গে এতগুলো দিন ধরে পরিচিত হয়েছেন, তাঁদের ভিড়ে সুরেশ বিশ্বাসের নাম সেভাবে শুনে ওঠা হয়নি, তাই না? আর সেজন্যেই আজ আপনাদের সুরেশ বিশ্বাসের গল্পই বলব।
গল্পের মতো শোনালেও এ কিন্তু কোনও গল্প নয়। নদিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা এই বাঙালি বিশ্বের দরবারে বাংলার নাম উজ্জ্বল করেছেন। গ্রামের ছেলে, তবে সেই গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখতে ঘোর আপত্তি ছিল সুরেশের। সেই বাইরে বেরোনোর তাগিদেই সুরেশ স্পেন্সেস হোটেলে ট্যুরিস্ট গাইডের চাকরি নেন। কিন্তু বহু দূর অবধি যে যেতে চায়, তার এই সামান্য চাকরিতে পোষাবে কেন? তাই তিনি চাকরি ছাড়লেন শীঘ্রই। তারপর ইতিউতি চেষ্টা করতে করতে একদিন পরিচয় হয়ে গেল এক সার্কাস দলের সঙ্গে। বরাবরের সাহসী, বলবান সুরেশ। সার্কাস দলের সবচেয়ে শক্তিশালী লোকটিকে পরাস্ত করে তিনি সার্কাস দলে নিজের জায়গা পাকা করে নেন। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখানেই ইয়োরোপের বিখ্যাত ব্যক্তি জাম্বাখের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। জাম্বাখের কাজ ছিল বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে বাঘ-সিংহকে বশে আনা। আর এই কাজটিই সুরেশ খুব অল্পদিনের মধ্যেই রপ্ত করে ফেললেন। শুধু তাই নয়, খালি হাতে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঘকে বশে আনা নাকি ছিল তাঁর বাঁয়ে হাত কা খেল্। অনেকেই বোধহয় মনে করতে পারবেন ফেলুদার সেই বিখ্যাত কাহিনি ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপে’র কথা। যেখানে বাঘকে হাঁ করিয়ে সেই হাঁ-মুখে মাথা ঢুকিয়ে দিতেন সার্কাসের রিংমাস্টার কারান্ডিকার, আর সেই প্রসঙ্গেই উঠেছিল সুরেশ বিশ্বাসের কথা- কেন-না সেই একই খেলা দেখাতেন এই অকুতোভয় বাঙালিও।
তবে শুধু বাঘের খেলা দেখানোতেই শেষ নয়। সার্কাসের সূত্রেই ব্রাজিলে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুরেশ। ব্রাজিলে সার্কাসে হিংস্র পশুর খেলা দেখানো চলছিল। এদিকে সুরেশ অঙ্ক, দর্শন ও রসায়নের মতো বিভিন্ন বিষয়গুলিতেও ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। ব্রাজিলেই স্থানীয় এক চিকিৎসকের কন্যার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। ২৫ বছরের তরতাজা যুবক সুরেশ তাঁর প্রণয়িনীর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে এবার যোগ দিলেন ব্রাজিল সম্রাটের সেনাবাহিনীতে। পরের বছরেই তিনি রিও দি জেনেরিও-র হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পান। হাসপাতালে থাকাকালীন তিনি অস্ত্রোপচার করতে শেখেন, আর তাতেও সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। এখানেও থেমে থাকেননি তিনি। পদোন্নতি হতে হতে সুরেশ হয়ে উঠলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।
কী ভাবছেন? এ কোন সুপারম্যানের কাহিনি আপনাদের বলছি? তাহলে আপনার বিস্ময়ের আরও কিছুটা বাকি।
১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রাজিলে এক ভয়ানক রাষ্ট্রবিপ্লবের সূচনা হল। আর এই অবস্থায় স্থলবাহিনীর সেনাপতির আহ্বানে মাত্র ৫০ জন সৈন্য নিয়ে রক্ষার জন্য এগিয়ে এলেন সুরেশ। শেষ রাতে শত্রুঘাঁটিতে সুরেশ ও তার সঙ্গীরা আক্রমণ করেন। সুরেশের অসামান্য সামরিক পারদর্শিতার জোরে শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করে যুদ্ধে জয়লাভ করে তাঁর দল। আর এভাবেই সুরেশ সেনাবাহিনীতে কর্নেল পদে উন্নীত হন।
কী? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে নিশ্চয়ই? মনে হচ্ছে তো, গল্প-উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা কোনও নায়ক? আজ্ঞে না। কালের নিয়মে চাপা পড়ে যাওয়া এক অসমসাহসী ব্যক্তিত্বের নাম সুরেশ বিশ্বাস। এতগুলো দিন পেরিয়েছে। তবুও তাঁর গল্প শুনলে গায়ের রোম খাড়া হয়ে ওঠে আজও। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে এমন কত রত্ন এদিক-ওদিক লুকিয়ে আছে, শুধু তাঁদের নামগুলো খুঁজে নেওয়ার অপেক্ষা।