সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মানেই ফেলুদা। অন্তত অনেকের কাছেই এরকম একটা ছবি যেন ধরাই আছে। সেই ফেলুদাকে নিয়েই আলাদা কোনও দুর্বলতা নেই বলে একবার এক লেখায় জানিয়েছিলেন স্বয়ং সৌমিত্র। আর তাতেই জুটেছিল কিশোরী ভক্তের তিরস্কার। আসুন শুনে নিই সেই গল্প।
বাঙালির কাছে ফেলুদা যেমন প্রিয়, তেমন ফেলুদা হিসেবে সর্বোত্তম যদি কাউকে বলতে হয়, তবে তিনি এক ও অদ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর পরে আরও বেশ কয়েকজন অভিনেতা ফেলুদার চরিত্রে রূপদান করেছেন ঠিকই, কিন্তু সৌমিত্রর ফেলুদা সবসময় আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে বাঙালি মননে।
-: আরও শুনুন :-
সৌমিত্র কি সত্যিই অমন ফরসা? গায়ে চিমটি কেটে দেখেছিলেন অজানা ভক্ত
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজে জানিয়েছিলেন যে, এই ফেলু চরিত্রের যে দুটি দিক তাঁক কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, তা হল, ফেলুর মননশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তি। বাঙালি দর্শক খেয়াল করে দেখেছে এবং মুগ্ধ হয়েছে এই দেখে যে, কীভাবে সেই বুদ্ধিবৃত্তিকে চোখের দৃষ্টিতে তুলে এনেছিলেন সৌমিত্র। স্বয়ং সত্যজিতের হাতে গড়া চরিত্র এবং সৌমিত্রর মতো অভিনেতার অসম্ভব ঋদ্ধ সুচিন্তিত অভিনয়ের যুগলবন্দি- ফেলুকে এমন এক উচ্চতা দিয়েছে যে আপামর বাঙালির কাছে ফেলু শুধু আদরের ধন নয়, একরকমের আধুনিক রূপকথা হয়ে উঠেছে। মনের গোপনে কোন বাঙালি না ফেলুদা হয়ে উঠতে চায়! সব মিলিয়ে ফেলুর জনপ্রিয়তাও তাই গোড়া থেকেই, আজও যা অটুট।
নিজের লেখায় একবার সৌমিত্র জানিয়েছিলেন, ফেলুদা চরিত্রে অভিনয়ে তাঁর ব্যক্তিগত একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছিল। কেননা, তার আগে পর্যন্ত নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি কোনও চরিত্রে অভিনয় করেননি। সে আশা যেমন পূরণ হল, তেমন একটা মুশকিলও দেখা গেল। ফেলুর জনপ্রিয়তা এমন মাত্রা স্পর্শ করল যে, প্রায় সকলেই তাঁকে ফেলুদা হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করল। বিশেষত শিশু কিশোরদের জগতে তো তিনি পাকাপাকি ভাবে ফেলুদাই হয়ে গেলেন। এখানেই মুশকিল। আসলে নিজের অভিনয় জীবনের গোড়া থেকে সৌমিত্র বিশেষ কোনও চরিত্রে চিহ্নিত হতে চাননি। অর্থাৎ যাকে বলা হয় টাইপকাস্ট হয়ে যাওয়া, তা সযত্নে প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। এমনকী তাঁর অভিনীত নায়ক চরিত্রের মধ্যেও তিনি চরিত্রাভিনয়ের ঘরানা এনেছিলেন, যা তখনকার দিনের নায়ক চরিত্রের থেকে বহুলাংশে আলাদা। এবং এ ব্যাপারে নিজের সুচিন্তিত মতামত লিখে জানিয়েওছিলেন তিনি। এবার সকলেই যখন তাঁকে ফেলুদা হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করলেন, তখন তাঁর অভিনেতা সত্তা একটু ফাঁপরে পড়ল বলা যায়। সৌমিত্র যে অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘ব্যক্তিগত অসুবিধা’ বলে। কেননা তিনি তো সত্যিই কোনও নির্দিষ্ট চরিত্রে চিহ্নিত হতে চাননি। একবার এক লেখায় সে কথাটিই লিখেছিলেন সৌমিত্র। জানিয়েছিলেন, ফেলুর প্রতি তাঁর বিশেষ কোনও দুর্বলতা নেই, আর পাঁচটা চরিত্রের মতোই তিনি ফেলুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
এই লেখার পরে সৌমিত্রর এক কিশোরী অনুরাগিনী বা বলা যায় ফেলুদার অনুরাগিনীর চিঠি এল। যেমন তেমন চিঠি নয়, ক্ষোভ জানানো চিঠি। কিশোরী সেই ভক্ত জানিয়েছিল, যে সৌমিত্রর এই মন্তব্য জানার পর থেকে ফেলুকে উপভোগ করতে তার যথেষ্ট অসুবিধা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইচ্ছে না থাকলেও সৌমিত্র পরিচালকের মর্জিমাফিক ফেলু হয়ে উঠেছেন মাত্র। সৌমিত্র তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, কিশোরীর সেই তিরস্কার মনে মনে গ্রহণই করেছিলেন তিনি। বুঝেছিলেন, দর্শক তাঁর নিজের স্বভাবমতোই একজন অভিনেতাকে গ্রহণ করবেন। কেউ রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে কেউবা চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। সেরকমই কিশোর-কিশোরীরা বা বহুসংখ্যক দর্শক যদি তাঁকে ফেলুদা হিসেবে গ্রহণ করেন, তবে তাঁর আপত্তি থাকা উচিত নয়। ওই চিঠি আর কিশোরীর তিরস্কার সৌমিত্রকে এনে দাঁড় করিয়েছিল এই উপলব্ধিতে। আর নিজের আগের মন্তব্যের জন্য যাঁদের মনে আঘাত দিয়ে ফেলেছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি মার্জনা চেয়ে নেন আর-একটি লেখার ভিতর দিয়েই।
ঠিক এই কারণেই তিনি হয়ে উঠতে পারেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একজন মহৎ শিল্পী, একটা জাতি যাঁকে অর্জন করে হয়তো একবারই।