গোপাল অতি সুবোধ বালক, এ কথা বর্ণপরিচয় পড়া সব বাঙালিই জানে। তবে হিংস্র বাঘের নামও যে গোপাল হতে বাধা নেই, সে কথাও বাঙালিই ভাবতে পেরেছিল। খালি হাতে লড়াই করে যে সেই হিংস্র বাঘকে সুবোধের মতো পোষ মানানো যায়, তাও দেখিয়েছিলেন এক বাঙালিই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
খালি হাতেই বাঘের সঙ্গে লড়াই করতেন এই বাঙালি। লড়াই করেই পোষ মানিয়ে ফেলতেন দুর্দান্ত বন্য পশুকে। একাধিক বাঘকে পোষ মানিয়েছিলেন সেভাবেই। একদিকে সার্কাস দল, আরেকদিকে সন্ন্যাস- দুয়ে মিলে অদ্ভুত বর্ণময় জীবন ছিল তাঁর। কে এই মানুষটি?
ঢাকার ছেলে শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় স্বপ্ন দেখেছিলেন, সৈনিক হবেন একদিন। ১৮৫৮ সালে, মহাবিদ্রোহের এক বছর পরে জন্ম তাঁর। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নিয়মিত শরীরচর্চা করেছেন, কুস্তি অভ্যাস করেছেন, সাহসেরও কমতি নেই। কিন্তু ঢাকা বিক্রমপুরের গ্রাম্য দুনিয়া থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ঠিক করলেন, কোনও দেশীয় রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। কিন্তু এ রাজ্য ও রাজ্য ঘুরেও আশ মিটল না। তবে ত্রিপুরায় গিয়ে রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের পার্শ্বচর হিসেবে নিযুক্ত হয়ে গেলেন শ্যামাকান্ত। আর এখান থেকেই বাঘের সঙ্গে আলাপ জমল তাঁর।
আরও শুনুন:
হাতিতে চড়ে দেখান বাঘের খেলা, দেশের প্রথম মহিলা সার্কাস খেলোয়াড় এক বাঙালি সাহসিনীই
রাজার সঙ্গে সেবার শিকার অভিযানে গিয়েছেন শ্যামাকান্ত। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রকাণ্ড এক বাঘ। খালি হাতেই বাঘের সঙ্গে লড়াই শুরু করলেন শ্যামাকান্ত। রাজার প্রাণ বাঁচাতে হবে তো! শেষমেশ ধরাশায়ী হল বাঘ। শ্যামাকান্তের বীরত্ব দেখে হতবাক রাজা বীরচন্দ্র। পরেও অবশ্য ঘটেছিল এমন ঘটনা। পাটনার এক নবাব চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, বাঘিনির সঙ্গে লড়াই করার জন্যে। খালি হাতে বাঘিনির খাঁচায় ঢুকে তার সঙ্গে কুস্তি করেন শ্যামাকান্ত। আঁচড়-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত, তবে শেষ পর্যন্ত জয় হাসিল করলেন তিনিই। নগদ দু’হাজার টাকা, দু’টি আরবি ঘোড়া এবং সেই সঙ্গে বাঘিনিকেও পেলেন পুরস্কার হিসেবে।
একটানা চাকরি করার মানুষ ছিলেন না শ্যামাকান্ত। বীরচন্দ্র মাণিক্যের চাকরি ছেড়ে বরিশাল জেলা স্কুলে ব্যায়াম শিক্ষক হয়েছিলেন বটে, তবে তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন সার্কাসের দল গড়ার। পাটনার সেই বাঘে মানুষে কুস্তির অনেক আগেই একটি চিতাবাঘ কিনে তার সঙ্গে হাতাহাতি করতেন নিয়মিত। তেমনটা চলতে চলতেই বশ করেন হিংস্র পশুটিকে। বাঘের সঙ্গে লড়তে পারেন বলে শ্যামাকান্তের খ্যাতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে দেশীয় রাজারাজড়াদের ডাকে এই খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন তিনি। ভাওয়ালের রাজা তাঁর ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার উপহার দেন। শ্যামাকান্ত সেই বাঘের নাম রাখেন ‘গোপাল’। খেলাচ্ছলে শ্যামাকান্ত তার মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিতেন।
আরও শুনুন:
পুলিশের ঘুম ছুটিয়েছিল কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার
১৮৯৪ সাল নাগাদ শ্যামাকান্ত ১৫০০ টাকা বেতনে ফ্রেডকুক নামের এক ইংরেজ সাহেবের সার্কাসে হিংস্র পশুর খেলা দেখানোর কাজ নেন। কিন্তু পরের বছরই সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের সার্কাস দল খোলেন। বছর দুই ভালোই চলেছিল, কিন্তু ১৮৯৭ সালে রংপুরে এক ভূমিকম্পে তাঁর সার্কাস ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু পশু মারাও যায়। দুটি মাত্র বাঘকে বাঁচিয়ে রেখে কলকাতায় ফিরতে পেরেছিলেন শ্যামাকান্ত। তবে এরপর আর সার্কাসের খেলা বেশিদিন দেখাননি তিনি। ছোটবেলা থেকেই টান ছিল আধ্যাত্মিকতার দিকে। ১৮৯৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর, ৪২ বছর বয়সে শ্যামাকান্ত গৃহত্যাগ করেন। স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে, কাশীতে এক সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নেন। ‘সোহং স্বামী’ নামেই জীবনের বাকি বছরগুলো কাটিয়ে দিয়েছিলেন এই মানুষটি, যিনি একা হাতেই বাঙালির ‘ভীরু’ অপবাদ ঘুচিয়ে দেওয়ার মতো সাহস রাখতেন।