সাম্প্রতিক সময়ে ‘কর্মবিরতি’ শব্দটি নিয়ে উত্তাল রাজ্য, এমনকি দেশও। এক নারকীয় ধর্ষণ-খুন কাণ্ডের জেরে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়ারা কাজে অসহযোগিতা করছেন, এই ইস্যুতে বাদ-বিবাদ ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছে। এমন সময়েই ফিরে যাওয়া যাক রবীন্দ্রনাথের কাছে। শিক্ষালয়ে অসহযোগকে কি প্রশ্রয় দিতেন তিনি? আসুন, শুনে নিই।
আন্দোলন মানেই উত্তেজনা। আন্দোলন মানে প্রবল আবেগ। যুক্তিক্রম সেখানে অনেকসময়ই পিছনের সারিতে বসে। তার উপরে আন্দোলনের জন্ম যখন হয় কোনও বড় বিপন্নতা থেকে, তখন সেই বিপন্নতা থেকে মুক্তির হদিশ মেলাই হয় আন্দোলনের লক্ষ্য। আর তা না মেলা পর্যন্ত, বিপন্নতাবোধ সম্পূর্ণ কাটিয়ে না ওঠা পর্যন্ত, নিরপেক্ষ যুক্তিতে ফেরা কার্যত অসম্ভবও। কিন্তু সে আন্দোলনকে যাঁরা বাইরে থেকে দেখছেন, তাঁরা তো ওই আবেগে সম্পূর্ণ শামিল নন। ফলে আন্দোলনের কাজকর্ম নিয়ে তাঁদের মনে নানা প্রশ্ন ওঠে, বিরোধও তৈরি হয়। বর্তমান সময়ে ‘কর্মবিরতি’ প্রসঙ্গটি তেমনই এক বিরোধের জন্ম দিয়েছে। আসুন, সেই প্রসঙ্গেই ফিরে দেখা যাক রবীন্দ্রনাথকে, যে কোনও সংকটের উত্তর খুঁজতে যাঁর কাছে যাওয়া চলে। কর্মবিরতি, বা সামগ্রিকভাবে অসহযোগ, শিক্ষালয়ে এই বিষয়টিকে ঠিক কীভাবে দেখতেন রবীন্দ্রনাথ? শুনে নেওয়া যাক সে কথাই।
আরও শুনুন:
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে সবল হোক মেয়েরা, চাইতেন রবীন্দ্রনাথও
রবীন্দ্রনাথ জানতেন, বয়স এবং পরিস্থিতির উত্তেজনায় ছাত্ররা কখনও কখনও আবেগ আর যুক্তির এই টানাপোড়েনে পড়ে। তাঁর ‘ঘরে-বাইরে’ বা ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে ছাত্রদের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার ছবি দেখিয়েছেন তিনি। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে বয়কট ও বিলিতি দ্রব্য বর্জনের উদ্যোগে তৎপর হয়েছিল ছাত্ররা। সর্বতোভাবে সরকারের সঙ্গে অসহযোগ করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু সেই উত্তেজনার মাঝে পড়ে বিপাকে পড়ছিল গরিব সাধারণ মানুষেরা। এখানে সেই কথাটিই নিখিলেশের বয়ানে বুঝিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ। নিজের জীবনে, নিজের তৈরি করা শিক্ষাঙ্গনেও তিনি সে কথাটি বোঝাতে চেয়েছিলেন। কেবল শাসকের বিরুদ্ধে অসহযোগ নয়, সহযোগের মন্ত্রে সাধারণ জনতার সঙ্গে যুক্ত হওয়াও যে কম জরুরি নয়, সে কথাই তিনি তুলে ধরেছিলেন। বিদেশি শাসকের বিরোধিতা থেকে সরে আসার কথা তিনি বলেননি, কিন্তু শান্তিনিকেতনের পড়ুয়াদের গঠনমূলক স্বদেশি মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। তাই গ্রামে গ্রামে গিয়ে গরিব সাধারণের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে পরিচিত হত তাঁর গড়া ব্রতী বালকদের দল। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে সন্দীপের চেলারা যা করেনি, রবীন্দ্রনাথ সে কাজই তাঁর পল্লি পুনর্গঠন পর্বে ছাত্রদের দিয়ে করিয়েছেন। কেন-না তিনি মনে করতেন, আন্দোলন মানে কেবল উত্তেজনার আগুন নয়, তার গড়ার দায়িত্ব রয়েছে অনেক বড়। শিক্ষালয়ে অসহযোগের নির্বিচার রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিতে তিনি রাজি ছিলেন না।
তবে, এ কথাও একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, ছাত্রদের এই দায়িত্বের পাশাপাশি প্রশাসককেও যে আরও দায়িত্ব নিতে হবে, সে কথা তিনি বারবার বলেছেন। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের প্রায় সমকালে ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন তিনি। যার নেপথ্যে রয়েছে সুভাষ-ওটেনের সেই সংঘাত। সেই বিষয়ে তদন্ত করতে, অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গড়েছিল সরকার। কিন্তু সবশেষে কলেজ কর্তৃপক্ষের দমনমূলক পদক্ষেপের মুখে পড়তে হল ছাত্রদেরই। বহিষ্কার করা হল তিন ছাত্রকে। তাঁদের নাম সুভাষচন্দ্র বসু, আনন্দমোহন দাস আর সতীশচন্দ্র দে। সেই পদক্ষেপের জেরে ক্রুদ্ধ, বিরক্ত রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ প্রবন্ধ। সেখানে ছাত্রদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ সাধারণভাবে যে কথাগুলি লিখলেন, যুগে যুগে ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে সে কথাগুলি মনে করে নেওয়া জরুরি।
আরও শুনুন:
দল বা কোন্দল নয়, ভয় না পাওয়াই রাজনৈতিক
তিনি লিখেছিলেন, “ছাত্রকে জেলের কয়েদি বা ফৌজের সিপাই বলিয়া আমরা তো মনে ভাবিতে পারি না। আমরা জানি, তাহাদিগকে মানুষ করিয়া তুলিতে হইবে। মানুষের প্রকৃতি সূক্ষ্ম এবং সজীব তন্তুজালে বড়ো বিচিত্র করিয়া গড়া। এইজন্যই মানুষের মাথা ধরিলে মাথায় মুগুর মারিয়া সেটা সারানো যায় না; অনেক দিক বাঁচাইয়া প্রকৃতির সাধ্যসাধনা করিয়া তার চিকিৎসা করিতে হয়।” অর্থাৎ, ছাত্ররা বিরোধিতা করলে তার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাবানের ঠিক কেমন আচরণ করা জরুরি, তারই পাঠ দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। আরও স্পষ্ট করে বলছেন, “ছাত্রদের ভার তাঁরাই লইবার অধিকারী যাঁরা নিজের চেয়ে বয়সে অল্প, জ্ঞানে অপ্রবীণ ও ক্ষমতায় দুর্বলকেও সহজেই শ্রদ্ধা করিতে পারেন; যাঁরা জানেন, শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা; যাঁরা ছাত্রকেও মিত্র বলিয়া গ্রহণ করিতে কুণ্ঠিত হন না।” বিপক্ষে কথা বললেই যে কাউকে প্রতিপক্ষ বলে ভাবতে নেই, ক্ষমতাবানকেই সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের উত্তেজনার ছোট গণ্ডির বাইরে আসার কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তবে তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, সেই বাইরে আসার কাজে যদি তারা ব্যর্থও হয় তবু তাদের বিরুদ্ধে বড়োরা চূড়ান্ত দমনমূলক নীতি গ্রহণ করবেন না। প্রশাসকরা পড়ুয়াদের আবেগকে অমর্যাদা করে তাদের বিরুদ্ধে দমননীতিকে সার্বিক করে তুলবেন না।
যদিও ইতিহাস বলে, পৃথিবীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্রদের স্বাধীন দাবিকে ‘অবিবেচনা’ মনে করে ‘বিবেচক’ শাসক পড়ুয়াদের প্রতি মুগুর চালাতে কুণ্ঠিত হয়নি। আন্দোলনের স্বার্থে শিক্ষালয়ে অসহযোগের বিষয়টিতে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ সহমত হতে পারেননি ঠিকই, তবে শাসকের এই ভূমিকার প্রতি তাঁর অসম্মতি ছিল আরও তীব্র, আরও স্পষ্ট। সুপ্রশাসক, হিতবাদী রাষ্ট্র পড়ুয়াদের প্রতিপক্ষ বলে মনে করে না, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।