রানির শখ হয়েছিল ভারতীয় খিদমতগার চাই। তাই রীতিমতো নির্বাচন করে দুই ভারতীয় যুবককে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ব্রিটেনে, মহারানির ভিক্টোরিয়ার দরবারে। তবে অল্প দিনের মধ্যেই রানির সুনজরে পড়লেন তাঁদের মধ্যে এক জন। হল পদোন্নতিও। রানির কর্মচারী থেকে অল্পদিনেই হয়ে উঠলেন রানির অন্যতম প্রধান সহচর, সর্বোপরি বন্ধু। খানসামা আর রানির আবার বন্ধুত্ব হয় নাকি! সে সময় রাজপরিবারের সব চেয়ে চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছিল এই সম্পর্কই। চক্ষুশূলও। আর সে জন্যই ইতিহাসের তলায় ধামাচাপা পড়ে রইল এক ভারতীয় খানসামার সঙ্গে রানি ভিক্টোরিয়ার অন্যরকম সম্পর্কের গল্প। শুনুন সেই কথা।
পেটানো চেহারা, শান্ত মুখ। প্রথম দর্শনেই ছেলেটিকে ভাল লেগে গিয়েছিল রানি ভিক্টোরিয়ার। অনেক দিনের শখ ছিল, একজন কি দুজন বাঙালি খানসামা হলে মন্দ হয় না! সে শখ পূরণও হল। সিংহাসনে বসার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ভারতের তরফে উপঢৌকন স্বরূপ মিলল দুই বাঙালি খানসামা। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন আব্দুল করিম।
১৮৮৭ সালের ২৩ জুন সেটা। উইন্ডসডোরের ফ্রগমোর হাউসে প্রাতঃরাশের টেবিলে রানির সামনে পেশ করা হল বাঙালি দুই খানসামাকে। রানিকে অভিবাদন জানিয়ে একটি সোনার মোহর নজরানা দিলেন করিম। পরনে লাল পোশাক আর সাদা পাগড়ি, সুদর্শন তরুণ করিমকে প্রথম দর্শনেই পছন্দ হয় রানির। ঘটনাচক্রে এই করিমের প্রতি আগ্রহ ক্রমে বেড়েই চলল রানির। তিনি আরও কথা বলতে চান করিমের সঙ্গে। কিন্তু মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াল ভাষা। করিমকে ইংরেজি শেখার নির্দেশ দিলেন রানি। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ইংরেজিতে চোস্ত হয়ে উঠলেন রানির খাস খানসামা। শুরু হল কথাবার্তা। নিজের দেশের আদবকায়দা, উৎসবের গল্প বলতেন করিম। রানি শুনতেন চুপ করে। একদিন তো পাকশালাতে নিজের মশলার বাক্সখানি নিয়ে হাজির হলেন করিম। রানির জন্য নিজের হাতে রেঁধে ফেললেন বিশেষ ‘কারি’। আর রানির তা এতটাই পছন্দ হল, যে ফরমান জারি হল, এ বার থেকে দুপুরের খাবারের সঙ্গে রোজ এই কারি তাঁর চাই-ই-চাই।
আরও শুনুন: বিলেতে মৃত্যু বড়লাটের, তবে কীসের টানে আজও নেটিভ শহরে ঘোরে হেস্টিংসের ভূত?
অবস্থা এমন হল যে করিমকে যেন চোখে হারান রানি। সব কাজেই তাঁর এই খাস খানসামাকে চাই-ই চাই। অনেক দিন ধরেই হিন্দুস্থানী কোনও ভাষা শেখার ইচ্ছা তাঁর। করিমের কাছেই শুরু হল তাঁর উর্দুর পাঠ। করিম তাঁকে দিলেন ছোট্ট একটা পকেট বই। রানি সেই বইটাকে কখনও হাতছাড়া করতেন না।
দরবারে আসার এক বছরের মধ্যেই পদোন্নতি হল করিমের। ১৮৮৮ সালের অগস্টে তাঁকে ইন্ডিয়ান সেক্রেটারি পদে বসালেন রানি। মিলল মুনসির খেতাব। করিমই প্রথম ভারতীয়, যিনি রানির ব্যক্তিগত সচিবের পদ পেয়েছিলেন। খাওয়ার টেবিলে রানির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা করিমের সব ছবি নষ্ট করে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এখন থেকে করিম আর সাদামাটা কোনও খানসামা নন, তিনি রানির খাস লোক, তিনি মুনসি। ওই নামেই যেন তাঁকে সম্বোধন করে বাকিরাও, আদেশ দিলেন রানি।
ব্যাপারটাকে ভাল ভাবে নিল না প্রাসাদের অন্যরা। কেউ বিদ্রোহ করলেন। কেউ বা রটিয়ে দিলেন, করিম ব্রিটিশ বিরোধী গুপ্তচর। তবে এসব কথায় কান দিলেন না একজন, তিনি স্বয়ং মহারানি।
আব্দুল করিমের জীবনীকার সুশীলা আনন্দ জানিয়েছেন, রানির চিঠি পড়ে তিনি জানতে পেরেছেন, করিম আর রানির মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা হত। প্রায় সব বিষয়েই অগাধ জ্ঞান ছিল করিমের। দর্শন থেকে রাজনীতি সব বিষয়েই সমান বাস্তববাদী ছিলেন তিনি। বুদ্ধি, মেধা, মনন তার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তি, সব দিক থেকেই একে অপরের সঙ্গে বাঁধা পড়ছিলেন তাঁরা। মনে রাখতে হবে, রানি তখন ষাটের কোটায়। করিম তখন নেহাতই অল্পবয়সি।
আরও শুনুন: ব্যবসায় মন্দা, দুর্গাপুজো করে নাকি বিপুল লাভের মুখ দেখেছিলেন এক ইংরেজ সাহেব
একবার দেশে ফেরার বায়না ধরলেন করিম। কিন্তু করিমকে কাছছাড়া করতে চাইলেন না রানি। উল্টে করিমের স্ত্রী-সহ বাকি পরিবারকেও ইংল্যান্ডে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন।
দেখতে দেখতে করিমের সঙ্গে রানির ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়তে লাগল। যা বাকি প্রাসাদের লোকেদের চোখে মোটেও ভাল ঠেকছিল না। প্রমাদ গুনছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। তাঁর অবর্তমানে করিমকে এদেশে টিকতে দেবে না কেউ, বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। তাই ভারতের মাটিতে একটুকরো জমি লিখে রাখলেন করিমের নামে। যাতে সেখান থেকে অন্তত করিমকে কেউ না উৎখাত করতে পারে।
বাকি অংশ শুনে নিন।