কালীঘাট আর বিয়ে। অনেকেই ভাববেন, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! কালীমন্দিরে বিয়ে হতেই পারে। কিন্তু কলকাতায় কালীমন্দির বলতেই প্রথমে যে মন্দিরের কথা মাথায় আসে, সেই ‘কলকাত্তাওয়ালির’ মন্দিরে বিয়ে বরাবরই বৈশিষ্ট্যে খানিকটা আলাদা। ঠিক কেমন সেই গল্প? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
খরচ হবে মেরেকেটে দশ টাকা। সময়ও লাগবে খুব বেশি হলে ১০ মিনিট। ব্যাস তাহলেই বিয়ে শেষ। ভাবছেন তো এমনটাও কীভাবে সম্ভব? একালে নাহলেও, একসময় ঠিক এমনটাই হত। তাও আবার কলকাতার বুকেই। প্রয়োজন বলতে স্রেফ পাত্র-পাত্রীর। এ যেন, মিয়া-বিবি রাজি তো কয়া করেগা কাজি-র বাস্তব রূপ। তবে এক্ষেত্রে কাজির বদলে বিয়ের দায়িত্ব একাহাতে সামলাতেন পুরোহিত মশাই। আর সবকিছুর সাক্ষী থাকতেন স্বয়ং মা কালী।
আরও শুনুন: ধর্মের সঙ্গে যোগ নেই আমিষের! ইলিশ ভালবাসতেন ‘সিদ্ধপুরুষ’ বিবেকানন্দও
সেকালের কলকাতার ছবিটা আজকের তুলনায় অনেকটা আলাদা। সবাই সবার মতো চলবে, এমনটা একেবারেই স্বাভাবিক মনে করতেন না অনেকে। সেখানে বিয়ের মতো গুরুগম্ভীর ব্যাপার নিয়ে যে যথেষ্টই মাতামাতি হবে তা বলাই বাহুল্য। জমিদারি প্রথাও তখন পুরোপুরি উঠে যায়নি। বাবু কালচারের রমরমা চোখে পড়ার মতো। তাই বিয়ের আগে দুই পরিবারের মধ্যে এমন অনেক বিষয়েই আলোচনা হত, যা আজকের দিনে অনেকে ভাবতেই পারেন না। প্রথমে অবশ্যই দুই পরিবারের ধার ও ভারের মাপজোক। কার কত সম্পত্তি সেই বিচারেই ঠিক হবে সম্পর্ক। এরপর ঠিকুজি কোষ্ঠী মেলানো তো রয়েছেই। জ্যোতিষের বিচারে রাজজোটক প্রমাণ হলেই চারহাত এক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এহেন পরিস্থিতিতে যদি কেউ ভালবেসে ফেলেন? সে তো আর এত মাপজোক করে হয় না। জমিদার বাড়ির ছেলেও প্রেমে পড়তে পারেন সাধারণ ঘরের কোনও মেয়ের। কিংবা উলটোটা। তাঁরা কী করবেন? লিভ-ইন সম্পর্কে থাকার কথা তখন ভাবনার অতীত। তাছাড়া বিয়ে না করলে সমাজেও স্বীকৃতি মিলবে না। কালীঘাট মন্দিরই ছিল এঁদের একমাত্র ভরসার জায়গা। আগে থেকে জানানোর কোনও প্রয়োজন নেই। মন্দিরে গিয়েও ‘বিয়ে করতে চাই’, এমন ঘোষণার প্রয়োজন নেই।
আরও শুনুন: ধরনা দিলেই আদায় হবে দাবি, রামায়ণ থেকেই কি জন্ম আন্দোলনের এই রীতির?
তাহলে, ঠিক কীভাবে বিয়ে হত এই মন্দিরে? সেই গল্পেই আসছি।
বরাবরই কালীঘাট মন্দিরে ঢুকলে, ঘিরে ধরেন পাণ্ডা কিংবা পুরহিতের দল। সেকালেও এমনটাই হত, একালেও হয়। তফাৎ বলতে তাঁদের কথা বলার ধরণ। মন্দিরে পুজো দিতে এলেই, সেকালে পাণ্ডাদের তরফে প্রশ্ন ভেসে আসত, ‘পাঁচ আনা না পাঁচ সিকের?’ ইঙ্গিত কত টাকার পুজোর ডালা হবে সেদিকে। বর্তমানে সেই টাকার অঙ্ক বদলেছে। তবে ধরণ বদলায়নি। এর মাঝে কেউ যদি খানিক রেগে গিয়ে বলেন ‘পাঁচ টাকার!’ ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট। পুরোহিত মশাই সবটা বুঝে যেতেন। ফিসফিসিয়ে জীজ্ঞাসা করতেন, ‘পাত্রী কোথায়?’ অর্থাৎ ওই টাকার অঙ্কই বুঝিয়ে দিত, কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে মন্দিরে এসেছে। আর এক্ষেত্রে সেই উদ্দেশ্য হল চারহাত এক করার। বলাই বাহুল্য, বাড়ি থেকে মেনে নিচ্ছে না, এমন সম্পর্কের পরিণতি দিতেই মন্দিরে হাজির হয়েছেন যুগল। তাই তাঁদের অপেক্ষা করানোর কোনও মানে হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যবস্থা হয়ে যেত সবকিছুর। নতুন কিছু কেনার প্রয়োজন পড়ত না। একই সামগ্রী ব্যবহার করে অনেক কুমারীর সিঁথি সিঁদুর রাঙা হত। সেখানে কোনও উকিল, বাড়ির লোক, কারও দরকার নেই। বিয়ের সব ব্যবস্থা একাহারে সামলে নিতেন পুরোহিত মশাই। আর পরিবারের মানুষজন উপস্থিত থেকে যে আশীর্বাদটুকু করতেন, সে দায়িত্ব সামলাতেন স্বয়ং কালী। বিয়ের আয়োজনও হত মন্দির চত্বরেই। মালাবদল, সামান্য কিছু মন্ত্র উচ্চারণ আর সবশেষে সিঁদুরদান। আর কিছুর দরকার নেই। সবশেষে মায়ের আশীর্বাদ অনেকটা সরকারি সিলমোহরের মত।
আরও শুনুন: গাঁটের কড়ি খরচ করেও স্বাদ মিলছে না, ইলিশ রান্নাতেই গড়বড় করছেন না তো?
এই কালীঘাট মন্দিরের ইতিহাস প্রায় সকলেরই জানা। সেখানেও তো সেই শাঁখার প্রসঙ্গ জুড়ে। বিয়েরে পর হিন্দু মেয়েরা নিষ্ঠাভরে যে গয়না পরে নেন। স্বয়ং কালী এই মন্দিরে এসে সেই শাঁখা পরেছিলেন। আর সেই মন্দিরই বছরের পর বছর ধরে দুট মানুষের বে-আইনি গোপন বাসনাকে এক মূহুর্তে খুশির আতরে চুবিয়ে এমন শাহেনশা করে দিচ্ছে। এই শহরের বুকেই এমন এক জায়গা, যেখানে মুহুর্মুহু সামাজিক নিয়মেরা নিষেধের বাঁশি বাজায় না। বাজালেও তা মন্দিরের ভিতর কার কানে কতটা পৌঁছবে তা বলাই বাহুল্য। যদি কোনও বেপরোয়া পিতৃপক্ষ পুলিশ-কাছারির হাত ধরে ঢুকেও পড়েন, সেখানেই থামতে বাধ্য হন। কারণ স্থানটি কালীঘাট। যে দেবভূমে, অন্য কারও আইন চলে না। হয়তো এই বিয়ের কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। তা হোক, মা কালীর ভারে আর পাণ্ডা পুরোহিতদের ধারে দিব্যি আছে কালীঘাট তার নিজস্ব ম্যারেজ আপিস নিয়ে। চিরকাল তাই ছিল। প্রয়োজনে আগামীতেও তাই থাকবে।