তাঁকে ধরতে ঘুম ছুটেছিল ইংরেজ পুলিশের। মোটা অঙ্কের টাকা ধার্য হয়েছিল তাঁর মাথার দাম হিসেবে। আরেক দিকে তিনিই আবার ছিলেন রান্নায় পারদর্শী। জাপানে আত্মগোপন করে থাকার সময়েও নতুনরকমের রান্না খাইয়ে মুগ্ধ করেছিলেন ভিনদেশি মানুষদের। এমনকি জড়িয়ে গিয়েছিলেন এক রেস্তরাঁর সঙ্গেও। তিনি, বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। তাঁর সাহস আর বীরত্বের কথা তো জানেন সকলেই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক রন্ধনপটু এই বাঙালির অজানা গল্পও।
দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেতে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত। সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিপ্লবীরা। খোদ বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেন রাসবিহারী বসু। দুর্ভাগ্য। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল বোমা। উপরন্তু, বড়লাটের দিকে বোমাটা যিনি ছুঁড়েছিলেন, সেই বসন্ত বিশ্বাসকে ধরে ফেলল পুলিশ। আর খ্যাপা কুকুরের মতো খুঁজতে লাগল রাসবিহারীকে। রাসবিহারী বসুকে কেউ ধরিয়ে দিতে পারলে বা কোনও খবর দিলে মোটা টাকা পুরস্কার পাবে সে, করা হল এমন ঘোষণাও।
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের, মৃত্যুর পর নাকি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়েছিলেন নিজেও
এই পরিস্থিতিতে দেশে থাকা যে নিরাপদ নয়, বুদ্ধিমান রাসবিহারী বসু তা ভাল করেই বুঝেছিলেন। অতএব ‘প্রিয়নাথ ঠাকুর’ নামে পাসপোর্ট জোগাড় করলেন তিনি। নিজেকে পরিচয় দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় বলে। ছদ্মবেশে ব্রিটিশের হাত পিছলে পালিয়ে এলেন জাপানে। সেটা ১৯১৫ সালের জুন মাস। কিন্তু বেশিদিন নিরাপদে থাকা গেল না। ২৭ নভেম্বর টোকিয়োতে লালা লাজপত রায়ের সঙ্গে সভা করার পর ব্রিটিশ সরকারের চাপে তাঁকে নির্বাসন দিল জাপান। আর এই সময়েই এগিয়ে এলেন এক জাপানি দম্পতি। আইজো সোমা ও তাঁর স্ত্রী কোকো। নিজেদের বেকারির পরিত্যক্ত গুদামঘরে এই বিদেশি বিপ্লবীকে আশ্রয় দিলেন তাঁরা। পরে রাসবিহারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নিজেদের মেয়ে তোশিকোর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন এই দম্পতি।
তোশিকো আর রাসবিহারীর প্রথম পরিচয় হয়েছিল এক ঘরোয়া ভোজে। যাঁরা তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তাঁদের নৈশভোজে ডেকেছিলেন দেশছাড়া এই বিপ্লবী। সেদিনও নাকি নিজের হাতে রান্না করেছিলেন রাসবিহারী। কিন্তু সে তো ঘরোয়া রান্না। রেস্তরাঁয় রান্না করছেন দুর্দান্ত বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, এ ঘটনা কীভাবে সম্ভব হল?
আরও শুনুন : বাংলা মানে শুধু মিষ্টি দই-রসগোল্লা নয়, বাংলাকে চেনা যায় আত্মসম্মানের গরিমাতেই
আসলে, জাপানের জনপ্রিয় বেকারি নাকামুরায়ার মালিক ছিলেন সোমা দম্পতি। আর সেখানেই একটি নতুন পদের অনুপ্রবেশ ঘটান রাসবিহারী। নাম দেওয়া হয় ‘নাকামুরা কারি’। জাপানিদের কাছে নতুন এই পদটি ছিল আমাদের চিরচেনা মুরগির হালকা ঝোল, সঙ্গে ভাত। শোনা যায় জাপানে বাছাই করা সরু চাল চাষ করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন রাসবিহারী। স্ত্রী তোশিকোর অকালমৃত্যুর পর আইজো সোমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনিই নাকি নাকামুরা বেকারিকে রেস্তরাঁয় পরিণত করেছিলেন। আর সেখান থেকেই গোটা জাপানে ছড়িয়ে পড়ে এক বাঙালি বিপ্লবীর পছন্দের এই রান্নাটি। এমনকি এখনও জাপানের অনেক রেস্তরাঁতেই মেলে নাকামুরা কারি। আর মেনুকার্ডে লেখা থাকে, এই আসল ভারতীয় পদটিকে জাপানে আমদানি করেছিলেন এক ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী। কেবল তাঁর লড়াইয়ের জন্য নয়, রান্নার প্রসঙ্গেও রাসবিহারী বসুকে মনে রেখেছে সে দেশ।