যেমন তার গড়ন, তেমন স্বাদ। বাঙালি মাত্রই বর্ষাকালে জিলিপিতে কামড় দিতে ভুল করে না। সেই জিলিপি নাকি বিদেশি? বাঙালি রসনায় জিলিপির স্বাদ যতই লেগে থাক না কেন, জিলিপি বাঙালি খাবার কি না, প্রশ্ন তা নিয়েই। আর জিলিপির বড় ভাই অমৃতি? সে বাঙালি না অবাঙালি ভেবেছেন কখনও? এই বর্ষার দিনে, চলুন, শুনে নেওয়া যাক এই দুজনের গল্প।
বর্ষা এল মানেই রথের রশিতে পড়ল টান। আর রথ বললেই কী মনে পড়ে? জিলিপি, তাই না? কেবল রথের মেলা কেন, বর্ষার সন্ধেয় জিলিপির সঙ্গে জমে ওঠা আড্ডাও কি কম টানে আমাদের? আর একটু গোলমেলে লোক দেখলেই, এই যাহ্, জিলিপির প্যাঁচের কথা মনে এল তো!
কিন্তু, বাঙালির জিভে জিলিপি যতই জাঁকিয়ে বসুক, সে নিজে কি আদৌ বাঙালি? উঁহুঁ! কাগজ দেখাতে বললে জিলিপি ডাহা ফেল করবে মশাই! তবে কাগজ না থাক, জিলিপির বয়সের গাছপাথর নেই। সেই তেরোশ শতকে মুহম্মদ বিন হাসান আল-বোগদাদি যে রান্নার বইখানা লিখেছিলেন, সেখানে জিলিপি সগৌরবে হাজির। মিশরে ইহুদিরাও নাকি এই মিষ্টি বানিয়ে ফেলেছিল সেকালে। রমজান মাসে ইরানে গরিব মিশকিনদের মধ্যে বিলি করা হয় জিলিপি। ওখানে অবশ্য এর নাম হয়েছে জেলেবিয়া। পণ্ডিতরা বলছেন, জিলিপি শব্দটা নাকি এসেছে ফারসি ‘যবালিয়া’ থেকে। মানে, গোল হয়ে পাক খেতে খেতে যাওয়া। আর, ফারসি-বলা তুর্কিদের হাত ধরেই ভারতে পা রেখেছিল আমাদের আজকের প্রিয় জিলিপি।
কেবল এই বাংলা নয়, ওপার বাংলাতেও জিলিপির কদর কম নয় কিন্তু। জিলিপি পুরান ঢাকার পুরনো খাবারগুলোর মধ্যে একটা। তারও আবার রকমফের আছে। সবচেয়ে বড় জিলিপিতে প্যাঁচ থাকে একটা-দুটো নয়, পাক্কা কুড়িটা! এর নাম শাহি জিলিপি। নামের মতো ওজনেও ইনি বেশ ভারিক্কি। এক কেজি থেকে চার কেজি অব্দি ওজন হয় এক-একখানার, ভাবতে পারেন! এলাহাবাদ বা ত্রিবেণীতে বসে পেটভরে জিলিপি খেলে পুনর্জন্ম হয় না বলে যে গল্পটা শোনা যায়, সে গল্পে ভাগ্যিস ঢাকার নাম ঢুকে পড়েনি!
তা জিলিপিকে নাহয় বিদেশি বলে ধরেই নেওয়া গেল। কিন্তু অমৃতি? শুনতেও যেমন, স্বাদেও অমৃতের থেকে বিশেষ ফারাক নেই। না না, আমি আপনি না, এই সার্টিফিকেট দিচ্ছেন স্বয়ং প্রেমেন মিত্রের ঘনাদা। কিন্তু অমৃতি যে কোথা থেকে এল, দেশবিদেশ ঘুরলেও তার খবর তিনি রাখতে যাননি। তিনি না বলুন, সুকুমার সেন অমৃতি বানানোর সব ক্রেডিট দিয়েছেন কলকাতার হালুইকরদের। কিন্তু, খোদ সম্রাট জাহাঙ্গিরের আত্মজীবনী ‘জাহাঙ্গিরনামা’-তে এক মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, তার নাম ‘জাহাঙ্গিরি’ বা ‘ইমরতি’। ময়দার বদলে এর উপাদান অড়হর ডাল। বাংলায় যদিও ব্যবহার করা হয় কলাইয়ের ডাল বাটা, কোথাও বা কাঁচা মুগ ডাল কিংবা বরবটির বেসন। উত্তরবঙ্গে ডালের সঙ্গে যোগ হয় আতপ চালের গুঁড়ো। এই অঞ্চলে অমৃতির নামটিও ভারী মিষ্টি। ‘কাঙনি জিলিপি’। মেয়েদের হাতের কঙ্কণ থেকে কাঙনি।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, অমৃতির নাম যতই সংস্কৃত ঘেঁষা হোক আর জিলিপিকে সংস্কৃতে ‘কুণ্ডলিকা’ বলা হোক, এরা কেউই আপনার ঘরের লোক নয়। তবে তাতে আপনার কী? পরকে আপন করে নিতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। আর তাই খাদ্যরসিক বাঙালির কাছে জিলিপি, অমৃতিও হয়ে উঠেছে আপনজন।