পয়লা, ফ্রেশ সকালের এক কাপ চা। তারিয়ে চুমুক বেশ; তাড়া নেই, হুড়ো নেই। হাতে কাগজ, কাগজে মৃত্যু, তবু প্রশান্তি, তবু শান্তি, তবু অনন্ত জাগে। কর্মেও লাগে না, মর্মেও না। তবু রাঙা হাসি রাশি রাশি। পাড়াবাসীর প্রমিত অভ্যর্থনায় ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় পড়েছে তার হাঁটার ছাপ। পয়লা, পাড়ায় নতুন।
নতুন বছরের শুরুতে পয়লার কথা লিখলেন, সরোজ দরবার।
পয়লা, পাড়ায় নতুন। যার সঙ্গেই দেখা, গালভরা হাসি। ঝামেলার গল্প নেই। ময়লা ফেলা নিয়ে ঝঞ্ঝাট নেই। কার গ্যারাজের জল গড়িয়ে কার গেটে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেসব নিয়ে ঝামেলা নেই। পুজোর চাঁদা দেওয়া নিয়েও দর কষাকষি নেই। পয়লা, ফ্রেশ সকালের এক কাপ চা। তারিয়ে চুমুক বেশ; তাড়া নেই, হুড়ো নেই। হাতে কাগজ, কাগজে মৃত্যু, তবু প্রশান্তি, তবু শান্তি, তবু অনন্ত জাগে। পয়লা সুজন না সুমন, কল্যাণ না ব্রাত্য কে জানে! তাকে দেখে কুশল বিনিময়ের স্মিত হাসি, ডান দিকে ঘাড় হেলা। কর্মেও লাগে না, মর্মেও না। তবু রাঙা হাসি রাশি রাশি। পাড়াবাসীর প্রমিত অভ্যর্থনায় ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় পড়েছে তার হাঁটার ছাপ। পয়লা, পাড়ায় নতুন।
পয়লা, নতুন পাড়া। কিছুই চেনা না। রাস্তা এক, একই না। অনভ্যাসে হোঁচট। ভাগ হয়ে যাওয়া গলির মুখে এসে দু’দণ্ডের অশান্তি। কোন দিক? কোনটা ঠিক দিক! পরিবর্তনে বিভ্রান্তি। রিকশার ভাড়া। দেওয়ালের গায়ে রেট চার্ট, পুরনো, তবু নতুন করে দেখা। যাবেন নাকি? কেন যাবে না! পুরনো প্রশ্ন, নতুন করে জিজ্ঞেস করা। নতুন মাছের বাজার মাছেই ভর্তি, তবু অচেনা। তোবড়ানো হাঁড়ি, হাঁড়ির ভিতর জল, জলের উপর ব্যাপারির হাত, হাতের কায়দায় ছপাৎ স্বর- মাছ কি জ্যান্ত? ঠকাবে না তো! নতুন সন্দেহ। পুরনো পাড়া চোখ বুজে হারমোনিয়াম। নতুন পাড়া নতুন গান তোলা।
‘প্রতিটি নতুন গান মাসের পয়লা’ -বটেই তো! পয়লা, অর্জন এবং উপার্জন। এটুকুই শুধু! টাকা মাটি, মাটি টাকা, তোমার মন নেই, পয়লা? আছে তো! মধ্যবিত্তের সুবাদে। এমনিতে মধ্যবিত্তের বেশ বদনাম। স্বার্থপর, কুনো। ক্ষেত্রবিশেষে বুনো। ঈর্ষা আছে, ভরসা নেই। আত্মায় বিশ্বাস, আত্ম-য় নেই। তবু তো বর্গ। ফেলে দেওয়ার উপায় নেই। গরিবে আর বড়লোকে বনিবনা নেই। মধ্যবিত্তের দুদিকেই আনাগোনা। গরিব থেকে সে ধনী হয়ে উঠতে চায়, কিন্তু তত বড় তাকে হতে দেওয়া হয় না। অতএব আদতে সুবিধাভোগী হয়েই থেকে যায়। উপনিবেশের প্রভুরা দীক্ষা-শিক্ষা দিয়ে চাকরি দিয়েছিল। শিক্ষিত চাকুরিজীবী শ্রেণি। যেন স্পেশাল ট্রেন। অর্থ কিঞ্চিত তাদের হাতে থাকে বটে, তবে সামর্থ বড় বেশি কিছু নয়। বেতনের অর্থ থেকে তাই সম্মানের পরমার্থেই জোর বেশি। কেননা যা অর্থ হাতে আসে তাতে মাসভর একই মাত্রার তালে চলে না। মুদির দোকানের খাতা, ছেলেমেয়ের প্রাইভেট মাস্টারের বেতন, ঠিকে ঝি-র পয়সা, গানের মাস্টারের অ্যাডভান্স, ধোপা-নাপিত, ধারশোধ, বাড়ির বয়স্কের অসুখ-বিসুখ, ডাক্তারের ফিজ, ওষুধ দোকানের বিল, তার উপর আবার বিমা কোম্পানির বায়না। তা এতকিছু সামলে হাতে আর থাকে কী! কস্তে পুত্রঃ… কা তব কান্তা… নুন আনতে ফুরোয় পান্তা, অতএব সংসার অতীব বিচিত্র, এক পক্ষ যেতে না যেতে পকেটে অমাবস্যা। টেনে আর টুনে। সংসার যেন ইলাস্টিক। কোনওক্রমে চালানো। দিন বাড়ে ঘণ্টায়। রাত বাড়ে চিন্তায়! ধার না করলে আর হাত চলে না, বেহুলার ভেলা তবু থামে না। মাসের শেষ শনিবারে পকেট খালি করার মতো বোকামি প্রমথ- প্রমথরা আর কতবার করতে পারে! পারে না। ‘মাংস আনতে গেলে কেন?’- অমিয়ার স্বরে তাই ক্ষোভ থাকে না, অনুমোদন নয়, শুধু একফোঁটা কৌতূহল- ঘামাচি মারার মতো নিষ্পৃহ। তবু ওই মাসশেষের বোকামি করার কারণ একটাই, সকলে খুশি ব্যস! এর বেশি মধ্যবিত্তের আর চাওয়ার কী ছিল! হিসেবে বাঁধা জীবনে বেহিসেবি হওয়ার সাধ বা সাধ্য কোনওটাই তার থাকে না। থাকলে মতি নন্দীর গল্প, নইলে গয়ংগচ্ছ। তা গয়ংগচ্ছের ভিতরই নতুন গল্প হয়ে পয়লা আসে। বেতনের দিন। পকেটে রেস্ত। মনে ফুর্তি। বেসিহেবি হওয়ার লাইসেন্স। হয়তো মাংস। আলু ক-টা বেশি। এক বাটি নাহয় ওই বুড়োকেও দিয়ে আসা। আর পাড়ায় ভালো পেনাল্টি মারে যে ছেলেটা – চাঁদু ভোলা যা হোক একটা নাম দিয়ে দিলেই হল – তাকেও একটু ডেকে বলা, মুখে দিয়ে যাস বাবা! আহ, কী শটটাই না নিয়েছিলি! এই তো মধ্যবিত্তের পয়লা। প্রমথর বোকামির বাইরে একদিনের পাঁজিপুথি মানা চালাকি। মেজাজ-মর্জিমাফিক একটা দিন। অতএব পয়লার মান আছে, মনও আছে। অর্থে পণবন্দি বলে পয়লার নেহাত বদনাম করা চলে না। পয়লা খানিক আনন্দের। যেন খানিক অকাজেরও। যেন জীবনের বাঁধা দিনের হিসাবে অতিরেক। অর্জন, সাধপূরণ, আনন্দ পয়লার গায়ে। হয়ে-ওঠা নতুন একটা গানের মতোই।
পয়লার তাই আলাদা গ্রামার, আলাদা গ্ল্যামার। ব্যাখ্যার অতীত। যেন উত্তমকুমার। এভারগ্রিন। দেবতুল্য। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। অথচ গুঁড়ো গুঁড়ো নক্ষত্র মিশে থাকে জীবনে। খানিকটা স্বপ্নের মতোন। পয়লা তাই খানিক অ্যাবসার্ডও। যেন তার স্মৃতি নেই। দেশভাগ হয়ে উচ্ছিন্ন হওয়া নেই। সেই বিজয়গড়, আজাদগড়, সেই কলোনি, দরমার ঘর- যেন তার কিচ্ছু নেই। ন-কাকা নকশাল ছিল কি-না মনে নেই। ছোটপিসি কালো বলে বিয়ে হল না আর পাড়ার নীতা নামের মেয়েটা সেই যে মুখে রক্ত তুলে মরে গেল না গেল না, কিছুই স্মরণে আসে না। যেন তার চটকল বন্ধ হয়নি। ভিআরএস নেই। ইউনিয়ন নেই। যেন তার পাড়ার শহিদের বেদিতে দাঁড়িয়ে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বলা নেই। স্লোগান, মিছিল আর সেই পুলিশের মার খাওয়া নেই। বন্ধ কলের সামনে গান গেয়ে লোক জোগাড় নেই, খালি গলায় ডিঙ্গা ভাসানোর ডাক নেই। পয়লা যেন উদভ্রান্ত। জনতাজঙ্গলে জেগে থাকা একলা টিফো। বাঙালিত্বের ভার না সইতে পেরে বাঙালিয়ানার যত দায় তার উপর ঠেলে দিয়েছে কারা। পয়লা তাই সেজেগুজে ফুলবাবুটি। যেন, পুরাতনী গান। পুরনো মেজাজ। এদিকে তালপুকুরের সঙ্গে ঘটির মুখ দেখাদেখি নেই। পয়লা এরকমই অ্যাবসার্ড। তা এমন পাগলদশা তার করল কে? পাড়ার যত পুরনো পাগল সবার ইতিহাস আছে। কেউ প্রেমে ব্যথা পেয়ে, কেউ অনেক পড়েও চাকরি না পেয়ে, কেউ আবার এমনিই সুচিত্রা সেনের জন্য; পলিটিক্যাল কারেক্টনেসে আটকে যাবে, তবু না বলে উপায় নেই যে, পয়লার এমন পাগলদশা হল কী করে! আহা রে মুখের দিকে তাকালেও মায়া হয়। গরমে, ঘেমে, তেতেপুড়ে কী অবস্থা। একে কেউ শরবত খাওয়ায় না। কবে যে ঠিক বাজারের ভালো লেগে গেল পয়লাকে, আর মিডিয়া বাঙালিয়ানা উদযাপনে পয়লার উপরই বাজি ধরল- তারপর তো সকালে রবীন্দ্রনাথ, বিকেলে জলসা, আড্ডার পর আড্ডা, মেলা, ভাড়ার মেলা, লেখক, সেমিনার, আড্ডা, সই, পাঞ্জাবি, শাড়ি, হালখাতা, ক্যালেন্ডার, নস্টালজিয়া আর গরমে শুকিয়ে যাওয়া রজনীগন্ধার ঘোলাটে গন্ধ- কী হুজ্জত কী হুজ্জত! পাগল না হয়ে পয়লা আর যায় কোথায়! আজকাল নাকি সে ভোম হয়ে শিব-মনসার থানে বসে থাকে। পয়লা, জানে সে অ্যাবসার্ড, তার কোনও স্মৃতি নেই, গন্তব্যও নেই। মহামান্য কামু কী বলেন, পয়লা কি এবার তাহলে আত্মঘাতী হবে! হতেই পারে, যেহেতু পয়লা নিখাদ বাঙালি, নীরদ চৌধুরী দূরে দাঁড়িয়ে হাসেন মন্দমৃদু।
পয়লাকে নিয়ে অতএব শুরু হয়ে গেল ফক্কুড়ি। প্রেমের কবিকে জিনস পরা ফুটফুটে রাজপুত্তুর এসে বলে, ‘ওই গাছের নীচে আমার পয়লা কাজ ওই গাছের নীচে আমার / দোসরা কাজ ওই গাছের নীচে আমার তেসরা…’! বলে বিদ্রুপের হাসি। যা চ্চলে! পয়লা কি এতটাই ফেলনা, যে, পয়লা-দোসরা-তেসরা সব বিকিয়ে যাবে মুড়ি-মুড়কি এক দরে! পয়লা প্রেম, পয়লা বিচ্ছেদ বুকের বাঁদিকে আলাদা আলগোছে তোলা থাকে না, তা আবার হয় নাকি! হতে পারে, বানিয়ে তোলা পয়লার চক্করে পয়লার প্রকৃত প্রস্তাব খানিক হাওয়া হাওয়া। পয়লা এখন পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। নেতাদের মতো শোভাযাত্রা তার। রঙিন কুলো, লাল লেশ লাগানো হাতপাখা আর প্যাঁচায় নকশাদার পয়লা। জানে সে, দিনে দিনে বড় ক্লিশে; নতুনের সঙ্গে তার কথা হয় না বহুদিন। সেই নতুন, যে-নতুন নিষ্ঠুর। সে সব ভেঙেচুরে দেয়। বলবে, পরিবর্তনই শাশ্বত। এই বুঝি তুমি পেয়ে গিয়েছ স্থিরবিন্দু, এই বুঝি তুমি নিজেকে বেঁধে ফেলেছ চেনা সুরে, বাপু হে, তাহলে ছাড়ো তোমার আরামযাপন। ভাঙো। পয়লা ভাঙা কী হবে? নিজেকে। ভেঙে ভেঙে দেখো এক জীবনে জমাতে পারো কতগুলো জন্মান্তর। পূর্বজন্ম নেই, সোনার কেল্লা থাকলেও নেই, না-থাকলেও নেই। জীবনে বহুবার তবু পয়লা আনা যায়। নতুনকে ডেকে। সেই পয়লার দেখা পেতে হলে, এ ঘর বহু যতন করে ধুতে মুছতে হবে। বহুবার সম্মুখে দাঁড় করাতে হবে নিজেকেই। নিজেকে কি আর সেভাবে লক্ষ্য করা যায়! যেমন রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ করেন জীবনানন্দ, প্রতিবার নতুন করে ভেঙে আবার গড়ার নিরিখে। আর দু’জনের কী গোপন চলাচল, জীবনানন্দ নিজেও গড়িয়ে যাবেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ থেকে ‘বেলা-অবেলা-কালবেলা’-র নতুনে। বুদ্ধদেবের চিনতে তাই কষ্ট হবে তাঁকে। এই নতুন, প্রতিটি নতুন- জীবনের পয়লা। তা সে পয়লাকে সহ্য করার হিম্মত আছে নাকি! কে আর নিজেকে খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! এতএব পয়লা আসে, যায়। কী আসে যায়! যে নতুন নিয়মমাফিক তা আদতে পুরাতন-ই।
অতএব পয়লা পাড়ার সেই ভালো ছেলে, যার মাথা ছিল, অনেক সম্ভাবনা ছিল, তবু বখে গেল। যেন কমিউনিস্ট বাড়ির ছেলে গিয়ে নাম লিখিয়েছে সুবিধাবাদী কোনও দলে। তাকে ফেলেও দেওয়া যায় না, মেনেও নেওয়া যায় না। লটারি কাটা। যদি একদিনে ফাটকা কোটিপতি। একদিন বাঙালিয়ানা। চারানা-আটানা যা হয়! তা সেই সমুদ্রছেঁচা অমৃতে কি বড় রাজনৈতিক আগ্রাসনের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে! কোণঠাসা বাঙালি, ঈশান কোণে মেঘ। অশনিসংকেত। পয়লা আর এসব নিয়ে ভাবে না। ভাবতে চায়ও না। গ্রীষ্মের দারুণ উত্তাপেও পয়লা তাই ভীষণ নিরুত্তাপ। ঠিক আমাদের মতোই। নইলে কী আর দুনিয়াশুদ্ধ লোক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত, কেমন করে রোজ জনমানবহীন হয়ে উঠছে গাজা! পয়লা জানে, নিশ্চিতই জানে, শিশুকে রক্ষা করতে অপারগ বিশ্বে সে আর নতুনের নামান্তর নয়, প্রকত প্রস্তাবে অবান্তর। কেননা এ-পৃথিবীর মৃত সন্তানের সামনে যে কোনও শোভাযাত্রাই অশোভনীয়।