কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মনের কথা দেওয়া নেওয়া হয়েছিল দুজনের। একজন মুখ ফুটে সে কথা জানাতে পেরেছিলেন। অন্যজন হয়তো বলেছিলেন মনে মনে। আর সেই না-বলা কথাটুকুকে বুকে আঁকড়ে ধরেই দশ-দশটা বছর পথ চেয়ে ছিলেন এক অগ্নিকন্যা। অপেক্ষা করে ছিলেন সেই অগ্নিপুরুষের জন্যে। দেশের জন্য ভালবাসা আর ব্যক্তিগত ভালবাসা কখন যেন মিলে গিয়েছিল এই দুই স্বাধীনতা সংগ্রামীর মনে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই আশ্চর্য ভালবাসার আখ্যান।
সাধারণ বাঙালি মেয়েদের চেয়ে বেশ খানিকটা লম্বা আর বলিষ্ঠ গঠনের এই মেয়েটিকে দেখলে অনেকেই নাকি অবাঙালি ভেবে বসতেন। গায়ের রংও নাকি ছিল টকটকে ফর্সা, আর মুখে মিষ্টি হাসি লেগেই থাকত। কিন্তু এই নরম সৌন্দর্যের আড়ালে যে জোরালো মনটি লুকিয়ে ছিল, তার পরিচয় পেয়েছেন কমজনই। যে মনের জোর নিয়ে একদিন পরিবার পরিজন সবকিছু তুচ্ছ করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ব্যক্তিগত ভালবাসার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করার তাগিদও জুগিয়েছিল সেই মনের জোরই। দেখাসাক্ষাৎ তো দূরের কথা, দশ-দশটা বছর প্রিয় মানুষটির খোঁজ পর্যন্ত পাননি তিনি। তবু দেশের প্রতি ভালবাসাই বুঝি এক সূত্রে বেঁধে রেখেছিল তাঁদের। আসলে তাঁদের গল্পটা যে শুরুই হয়েছিল সেই সূত্র ধরেই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়েছিলেন তাঁরা। আর তার দরুনই একদিন একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ইংরেজ শাসকের বিচারের কাঠগড়ায়। সেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই একে অপরের কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন তাঁরা। পরবর্তী কালে গোটা আত্মজীবনী হারিয়ে ফেললেও যে অঙ্গীকারের কথা টুকরো টুকরো লেখায় ধরে রেখে গিয়েছেন সেদিনের সেই মেয়েটি, অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত।
আরও শুনুন: অভিনব ঘটনা, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে মহাকাশ থেকে ভেসে এল শুভেচ্ছাবার্তা
কল্পনা জানিয়েছেন, ধরা পড়ার পর তিনজনকে নিয়ে নতুন করে মামলা শুরু হয়েছিল। তিনি ছাড়া বাকি দুজন ছিলেন তাঁর মাস্টারদা আর ফুটুদা। সেই মাস্টারদা, যিনি একদিন রাতের অন্ধকারে কল্পনাকে দেখে চমকে গিয়েছিলেন। সেদিন বৃষ্টিতে ঢেকে গিয়েছিল চারদিক। গ্রামের জলকাদা ভরা রাস্তায় চলাই দায়। তারই মধ্যে অভিভাবকদের ফাঁকি দিয়ে শহর থেকে চলে এসেছিলেন কল্পনা, তাঁর স্বপ্নের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনকে একবার দেখার জন্য। আর অন্যজন, কল্পনার ফুটুদা ওরফে তারকেশ্বর দস্তিদার। তিনিই সেই মানুষটি, যাঁর অপেক্ষায় জীবনের দশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন কল্পনা। জানতেও পারেননি, আর কোনও দিনই যে দেখা হবে না তাঁদের দুজনের।
আরও শুনুন: অঞ্জনের গানে নয়, বাস্তবেও ছিলেন বেলা বোস, চেনেন সেই সাহসিনীকে?
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলাতে কল্পনা ও তারকেশ্বর দুজনেই ধরা পড়েছিলেন। সালটা ১৯৩৩। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’, এই শিরোনামে কল্পনা লিখেছেন, “আমরা কাঠগড়ায় একসঙ্গে দাঁড়াতাম। সেই সময় একদিন ফুটুদা বলেছিলেন, তোকে ভালো লাগে। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি? আমার মৌনতায় হয়তো সম্মতি ছিল।” কিন্তু কল্পনা জানতেই পারেননি, অনতিকাল পরেই সেই মামলায় ফাঁসির সাজা পাবেন সূর্য সেন আর তারকেশ্বর দস্তিদার। ১৯৩৪ সালেই ফাঁসি হয়ে যায় তাঁদের। রায়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়েছিল কল্পনারও। তবে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, সি.এফ অ্যান্ড্রুজ, এমন অনেকের প্রচেষ্টায় সেই সাজা রদ হয়েছিল শেষমেশ। ছ’বছর কারাবাসের পর মুক্তি পান কল্পনা। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪৩ সালে বম্বের এক কনফারেন্সে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি. সি যোশী। তার উত্তরে কল্পনা জানিয়েছিলেন, তারকেশ্বরকে কথা দিয়েছেন তিনি। কী হয়েছিল তারপর? নিজের স্মৃতিকথায় কল্পনা লিখেছেন, “যোশী বলল, তুমি জানো না ওর ফাঁসি হয়ে গেছে। ও তো আর কোনদিন আসবে না।”
দলের অন্যান্যদের কথায় শেষ পর্যন্ত যোশীকে বিয়ে করেছিলেন কল্পনা। কিন্তু তারকেশ্বরকে ভোলেননি তিনি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসও মনে রেখে দিয়েছে দুই বিপ্লবীর এই না-হওয়া ভালবাসার কাহিনিকে।