কোনও নারী যৌন হেনস্তার কথা জানালে তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে? সে পাঠও দিয়েছিল প্রাচীন সাহিত্য। কীভাবে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কোনও নারী জানাচ্ছেন তিনি যৌন হেনস্তার শিকার। অথবা অভিযোগ তুলছেন ধর্ষণের। আশ্চর্যের কথা হল, প্রথমেই অনেকগুলো আঙুল ছুটে আসছে সেই মেয়ের দিকেই। তাঁর পোশাক কেমন ছিল, তাঁর চরিত্র কেমন, তাঁর পুরুষ বন্ধু আছে কি নেই, এমন নানারকম প্রশ্ন। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, তিনি ওই সময়ে ওখানে কেন গিয়েছিলেন বা কী করছিলেন। কীভাবে ধর্ষণ বা হেনস্তা হল, সেই তদন্তে মাথা না ঘামিয়ে যেন নির্যাতিতাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করান অনেকে। অথচ কোনও নির্যাতিতা মহিলার সঙ্গে ঠিক কেমন ব্যবহার করা উচিত, কবেই সেই পাঠ দিয়ে গিয়েছিল প্রাচীন সাহিত্য। সেখানে রানি ধর্ষিতাকে অপমান করা মাত্রই তাঁর দিকে প্রায় তেড়ে গিয়েছিলেন সর্বজনমান্য এক পণ্ডিত। রানিকে কড়া ভর্ৎসনা করেই তিনি বুঝিয়েছিলেন, আসলে ধর্ষিতার সঙ্গে ঠিক কেমন আচরণ করা কাম্য।
আরও শুনুন:
এ কাহিনি জানাচ্ছে ‘সেকশুভোদয়া’। কেউ কেউ মনে করেন এ বই বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী হলায়ুধের লেখা। তাহলে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক এর রচনাকাল। কেউ কেউ আবার বলতে চান, কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর সময়ে এ বই লেখা হয়েছিল। সে যাই হোক না কেন, এর প্রাচীনত্ব নিয়ে সংশয় নেই। আর সেই বইয়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদেই পাওয়া যাচ্ছে, শাসকের সামনে এক নারীর ধর্ষণের অভিযোগ তোলার প্রসঙ্গ।
দেখা যায়, মাধবী নামে এক বণিক বধূ তার মুমূর্ষু স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে বদ্ধপরিকর। কেউ তাঁকে বাধা দিতে এলে তাকে তিনি ছুরি দিয়ে মারতেও উদ্যত। এই গোলমাল শুনে সেই নারীকে রাজসভায় আনালেন রাজা। বোঝাতে চান যে, সহমরণে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া রাজার পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে স্ত্রীহত্যার দোষ ঘটবে। বরং মাধবী বলুন যে, কেন তিনি বাঁচতে চাইছেন না আর। তখন প্রকাশ্য রাজসভায় সেই নারী অভিযোগ করেন, এক দিন গঙ্গাস্নানের সময়ে রানি বল্লভার ভাই কুমারদত্তের নজরে পড়ে যান তিনি। লম্পট রাজশ্যালক তখন থেকেই তাঁকে নানাভাবে প্রলোভন দেখায়, ভয় দেখাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ফন্দি করে মাধবীর স্বামী ও শ্বশুরকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করিয়ে এক দিন রাতে মাধবীর বাড়িতে ঢুকে তাঁর গায়ে হাত দেয় সে। মাধবীর চিৎকারে পড়শিরা ছুটে আসে, নির্যাতককে ধরে নিয়ে যায় মন্ত্রীর কাছে। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যক্তিটিকে শাস্তি দেওয়ার সাহস ছিল না মন্ত্রীর। এই অবস্থায় মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন মাধবী।
রাজসভায় মাধবীর এই অভিযোগের বৃত্তান্ত জানতে পেরে ছুটে আসেন রানি। সভার মধ্যেই মাধবীকে কুৎসিত গালি সহযোগে মারতে শুরু করেন। আর ঠিক এই সময়েই মাধবীর পাশে এসে দাঁড়ান গোবর্ধনাচার্যের মতো সর্বজনমান্য পণ্ডিত। কাহিনি জানাচ্ছে, রাজাকে ভয়ানক ভর্ৎসনা করে শাবল তুলে রানির দিকে তেড়ে যান তিনি। মনে করিয়ে দেন, বহু দিন আগে রাজা রামপালের একমাত্র পুত্র এক নারীকে ধর্ষণ করেছিল, সে কথা জানতে পেরে রাজা তাঁর নিজের ছেলেকে শূলে দিয়েছিলেন। সেখানে এক নারী ধর্ষিতা হয়েছেন, আর তাঁকেই তাড়না করা হচ্ছে! রাজ্যের রাজলক্ষ্মী বিদায় নিতে আর দেরি নেই, হুঁশিয়ারি দেন পণ্ডিত। লাঠি আর কমণ্ডলু নিয়ে রাজার সভা ত্যাগ করতে উদ্যত হন তিনি। সেই সময়ে রাজা নিজে তাঁর পায়ে পড়ে তাঁকে শান্ত করেন, এবং খড়্গ হাতে কুমারদত্তকে বধ করতে যান।
আরও শুনুন:
নির্যাতনের দামে কেনা, তাই খোলা আকাশের অধিকার মেয়েদেরও
রাজার কাছে বিচার পেয়ে শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিগ্রহকারীকে প্রাণভিক্ষা দিয়েছিলেন সেই নারী। কিন্তু এ ঘটনা আসলে বার্তা দিয়েছিল যে শান্তি ফেরানোর জন্য ন্যায়বিচার জরুরি। উলটে নির্যাতিতার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা, কিংবা ধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা রাজ্যের পক্ষেই ভালো হতে পারে না। ধর্ষণের অভিযোগ উঠলেই তাকে ‘সাজানো ঘটনা’ বা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলা, ‘এমনটা তো হতেই পারে’ বলাও কোনও শাসকের কাজ হতে পারে না। কয়েকশো বছর আগেই এই পাঠ শিখিয়ে দিয়েছিল বাংলা। তবে, আমরা সে কথা মনে রেখেছি কি?