কেবল সমাজের সংস্কারই নয়, বিদ্যাসাগরের ভিতর যে সংস্কারের মন ছিল, তা বয়ে গিয়েছিল আরও বিভিন্ন দিকেই। এমনকি প্রযুক্ত হয়েছিল শিক্ষা এবং ভাষার ক্ষেত্রেও। আর এই সামগ্রিকতা মিলিয়েই তিনি সম্পূর্ণ, এককও বটে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বীরসিংহ থেকে কলকাতায় আসার পথে কেবল মাইলস্টোন দেখে দেখে ইংরেজি সংখ্যা মুখস্থ করেছিলেন তিনি। আবার সংস্কৃত শিক্ষার সময়ও মেধার গুণেই অর্জন করে নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর উপাধি। নিজে এহেন উজ্জ্বল পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও, পাণ্ডিত্যের অতিরিক্ত অহংকারকে প্রশ্রয় দিতে রাজি ছিলেন না ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একেও একরকম ক্ষুদ্রতা বলেই মনে করতেন তিনি। বাঙালি সমাজের আরও অনেক ক্ষুদ্রতাকে যেভাবে তিনি সংস্কার করতে চেয়েছিলেন, এই ক্ষেত্রেও সেই একই অবস্থান নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
আরও শুনুন: গোড়ার শান্তিনিকেতনে ছাত্র নেই, বিদেশি অধ্যাপকের ক্লাসে ছাত্র হয়ে বসলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ
সাধারণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, যাঁরা সামান্য সংস্কৃত জ্ঞানকে পুঁজি করেই পণ্ডিতবিদায়ের লোভে চারদিকে ঘুরে বেড়াতেন, তাঁদের সরাসরি ‘ল্যাজকাটা’ কিংবা ‘টিকিদাস’ নামকরণ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। এঁদের জ্ঞান যতটুকু ছিল, সেই জ্ঞান জাহির করার ঝোঁক ছিল তার অনেক বেশি। একবার এক হিন্দুস্থানি পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে সংস্কৃতে কথাবার্তা শুরু করেন। এদিকে তাঁর ভাষা অশুদ্ধ, ব্যাকরণের দিক দিয়েও তাতে অজস্র ভুল। এর সমুচিত জবাব দিতেই বিদ্যাসাগর তাঁর সঙ্গে টানা হিন্দিতেই কথা চালিয়ে যান। আড়ালে নিজের সঙ্গীকে এ কথাও বলতে ছাড়েননি যে, “এ দিকে কথায় কথায় কোষ্ঠশুদ্ধি হোচ্চে, তবুও হিন্দি বলা হবে না!” আসলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে নিজের গভীর জ্ঞান থাকলেও, শুধু সংস্কৃতই বলতে বা লিখতে হবে, এমন গোঁড়ামিকে বিদ্যাসাগর প্রশ্রয় দেননি। তাঁর ভিতর যে সংস্কারের মন, তা শিক্ষা এবং ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়েছিল। এমনিতে সংস্কৃতের ঐতিহ্যের গুরুত্ব তাঁর কাছে কম ছিল না। সংস্কৃত কলেজে স্মৃতি পড়ানোর সময়েও তিনি যুক্তি দিতেন, স্মৃতি পড়লে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের চাকরি বাড়বে, হিন্দু বিধিতে তাদের পারদর্শিতা জন্মাবে। কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্যকে কীভাবে সংস্কার করে আজকের দিনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলা যায়, সেই ভাবনাও ছিল তাঁর। তাই সহজ সংক্ষিপ্ত পথে সংস্কৃত ব্যাকরণ শিক্ষার পথ খুঁজেছিলেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃতে সূত্র থেকে শব্দ-নিষ্পত্তির যে ধারা, সেই সূত্রগুলিকে একটা ধাঁচায় বেঁধে তিনি লিখলেন ব্যাকরণ কৌমুদী। সৌরীন ভট্টাচার্য বলছেন, আধুনিকতার ভাবনা দিয়ে, সংস্কারীর মন দিয়ে তিনি যা করলেন, তাকে একটা ‘বিকল্প ব্যাকরণ প্রকল্প’ বলা যায়। এও একটা আধুনিকতার লড়াই। আবার নতুন পাঠের যোগ্য করে তোলার জন্যই সংস্কৃত টেক্সটগুলি সম্পাদনা করে শকুন্তলা বা সীতার বনবাস লেখেন বিদ্যাসাগর। শুধু সংস্কৃতই নয়, ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝে শেক্সপিয়রের লেখা অনুবাদ করতেও পিছপা হননি তিনি।
আরও শুনুন: ধর্মের সঙ্গে যোগ নেই আমিষের! ইলিশ ভালবাসতেন ‘সিদ্ধপুরুষ’ বিবেকানন্দও
আসলে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হাত ধরে বাংলা শিক্ষার সেই যে প্রথম পর্বের সূচনা হয়েছিল, বিদ্যাসাগর তাকেই ক্রমাগত সংস্কার করে চলেছিলেন। শিক্ষার আধুনিকীকরণ সেই সংস্কারের একটি লক্ষ্য ছিল বটে, কিন্তু সেখানে নিজের পরম্পরাকেও বরাবর ছুঁয়ে ছিলেন তিনি। সেই আপন বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখার প্রবণতাটি তাঁর বহিরঙ্গেও জারি ছিল। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “ব্রাহ্মণ পণ্ডিত যে চটিজুতা ও মোটা ধুতিচাদর পরিয়া সর্বত্র সম্মানলাভ করেন, বিদ্যাসাগর রাজদ্বারেও তাহা ত্যাগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন নাই।” এর নেপথ্যেও ছিল নিজের সংস্কৃতিকে সম্মান করার ইচ্ছাই। আসলে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে এক জাতির জন্ম। বিদ্যাসাগরের সেই ভাবনা-দর্শন আজ কতখানি প্রাসঙ্গিক, নিজেদের দিকেই এখন সে প্রশ্ন করতে হয়। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, নিজের জীবনকেই তিনি পাঠ্য করে তুলেছিলেন। ‘বিদ্যাসাগর তাই একক’- সেদিনও ছিলেন, আজও তাই।