প্ল্যানচেট আর প্রেতসাধনা এক জিনিস না। প্রেতসাধনা করে মূলত ‘শয়তানের অনুসারীরা’। তারা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। অপরপক্ষে প্ল্যানচেট কিন্তু কোনও ভিন্ন শক্তির উপাসনা না। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মৃতদের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। ইউরোপ ও আমেরিকায় প্ল্যানচেটের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়েছিল একসময়। তবে প্ল্যানচেটের নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। জানেন কেমন সেই পদ্ধতি?
প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আত্মাকে ডেকে আনার ধারণা বেশ পুরনো। আঠারো শতক থেকেই প্ল্যানচেট নিয়ে গবেষণা ও মৃতদের আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টার কথা জানা যায়। ১৮৫৩ সালে অ্যালান কারডেক নামে এক ফরাসি ব্যক্তি দাবি করেন, সর্বপ্রথম তিনিই আত্মাকে ডেকে আনার উপায় আবিষ্কার করেন। এই সময় আত্মা নিয়ে কৌতূহল বাড়ছিল পশ্চিমের দেশগুলিতে। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তৈরি হয় একাধিক আত্মিক অনুসন্ধান কমিটি। ১৮৮২ সালে লন্ডনে গঠিত আত্মিক সমিতির সভাপতি ছিলেন খোদ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্রফেসর হেনরি সি জুইক। পরবর্তীতে মৃত আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগের এই চর্চা ছড়িয়ে পড়ে এশিয়াতেও।
‘প্ল্যানচেট’ শব্দটি কোথা থেকে এল? আসলে ১৮৮৩ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আধুনিক প্ল্যানচেট নিয়ে গবেষণা ও প্রয়োগ শুরু হয়। ফরাসি পরলোক তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এফ এস প্ল্যাঁশেত সারাজীবন আত্মার সঙ্গে জীবিত মানুষের যোগাযোগ নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়ে আত্মাকে আহ্বানের পদ্ধতির নাম রাখা হয় প্ল্যানচেট। প্ল্যানচেট নিয়ে একটা সময় কৌতূহল বাড়ে আমেরিকায়। সেটা উনিশ শতকের শেষদিকে। এর পেছনেও কিন্তু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। আসলে আমেরিকায় তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রতিদিন মারা পড়ছিল বহু মানুষ। কারো মা, কারো বাবা, কারো আদরের ভাই-বোন মারা পড়ছিল যুদ্ধে। এ অবস্থায় মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টায় প্ল্যানচ্যাটের প্রচলন হুড়মুড় করে বেড়ে যায়। কিন্তু প্ল্যানচেটের মাধ্যমে কীভাবে আত্মাকে ডেকে আনা হয়, এর নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি আছে?
আরও শুনুন: ফুচকার জন্ম নাকি দ্রৌপদীর হাতেই! কোথা থেকে এল এই লোভনীয় খাবার?
প্ল্যানচেটের নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। যেমন, একটি সাদা বোর্ডকে ব্যবহার করা হয় প্ল্যানচেটের সময়। বোর্ডটি সাধারণত কাঠ কিংবা তামা দিয়ে তৈরি করা হয়। বোর্ডের দু-দিকে ছোট ছোট ক্যাস্টরদানা রাখা হয়, যাতে বোর্ডটি সুবিধামতো চক্রাকারে ঘুরতে পারে। বোর্ডের মাঝখানে পেন্সিল ঢোকানোর জন্য ছোট একটি ছিদ্রও থাকে। পেন্সিলটির তীক্ষ্ণ দিকটি ছিদ্র ভেদ করে বোর্ডের নিচে রাখা কাগজ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই কাগজেই মূলত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের কাজটি লেখা হয়।
‘বোস্টন প্ল্যানচেট’ একটি পদ্ধতি। সাধারণত বিজোড় সংখ্যক লোক নিয়ে করতে হয়। এক্ষেত্রে নিয়ম হল অন্ধকার একটি কক্ষে সবাই সবার হাতের আঙুল ছুঁয়ে চক্রাকারে উপবিষ্ট থাকবে। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় সিয়ান্স। বাংলায় প্রেতচক্র। এদের মধ্যে একজন হবেন মিডিয়াম। যার শরীরের মাধ্যমে অশরীরী আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মিডিয়ামের হাতে পেন্সিলটি আলতোভাবে ধরা থাকে। প্ল্যানচেটের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসা বিদেহী আত্মা সেই মিডিয়ামের দেহে ভর করে তার হাত ধরে প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখিয়ে নেয়। এভাবেই চলে প্ল্যানচেট কথোপকথন।
আরও শুনুন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল ‘ভূত’, নাস্তানাবুদ হয়েছিল দুর্ধর্ষ নাৎসি বাহিনীও
তবে কিনা ঔপনিবেশিক ভারতে প্ল্যানচেটের রমরমা যতখানি ছিল আজ আর তত নেই। তবু, ভূত, আত্মা নিয়ে কথা উঠলে প্ল্যানচেটের কথা আসবেই। রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায়… কেউ অস্বীকার করতে পারেননি।