ফুচকা ভালবাসে না, এমন লোক এ বাংলায় বিরল। অবশ্য শুধু বাঙালি কেন, ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও তো এর কদর কম নয়। এমনকি বিদেশেও খুঁজেপেতে ফুচকার দেখা মিলে যাবে। এত যাকে ভালবাসেন, তাকে নিয়েই একটু গল্প শুনবেন নাকি?
ফুচকা যে ঠিক কবে, কোথা থেকে এসে আসর জাঁকিয়ে বসল, তা ঠিক করে বলা মুশকিল। অবশ্য লোকের মুখে মুখে একটা অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে। তাঁরা বলেন, ফুচকার খোঁজ মেলে নাকি খোদ মহাভারতে। তাও কে এই ফুচকা বানিয়েছিলেন জানেন? স্বয়ং দ্রৌপদী!
আরও শুনুন: Biryani: বাঙালির বিরিয়ানিতে আলুর ঠাঁই হল কীভাবে?
দ্রৌপদীর তখন বিয়ে হয়েছে সদ্য। পঞ্চপাণ্ডব এবং কুন্তী তখন বনবাসী। ভিক্ষা করেই প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতে হচ্ছে যেখানে, সেখানে তো খাবার নষ্ট করার প্রশ্নই ওঠে না। আর এই সময়েই নাকি একদিন বেঁচে গিয়েছিল আলুর তরকারি আর আটার মণ্ড। গত রাতের সেই বাড়তি খাবার কুন্তী তুলে দিয়েছিলেন দ্রৌপদীর হাতে, পরের দিনের খাবার বানাবার জন্য। সেখান থেকেই দ্রৌপদী বানিয়ে ফেলেন এক অদ্ভুত সুখাদ্য। তার নাম হয় ‘ফুলকি’। প্রাচীন ভারতের মগধ, অর্থাৎ আজকের বিহার অঞ্চলে এই গল্পটি প্রচলিত রয়েছে। বলাই বাহুল্য, এই গল্পের কোনও পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ইংরেজরা ভারতে আসার আগে যে এ দেশের মানুষ আলু কাকে বলে জানত না, সে কথা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। আসলে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে পৌরাণিক চরিত্ররাও হয়ে ওঠেন ঘরের লোক, যাঁদের জীবনে নিজেদের জীবনকে মিলিয়ে দেখতে চায় দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। তাই নিজেদের খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন থেকে তৈরি হয়ে যায় এমন কোনও মৌখিক গল্প।
আরও শুনুন: jalebi: জিলিপি নাকি ভিনদেশি? অমৃতির বাড়িই বা কোথায়!
তবে ফুলকা নামে একরকম রুটি কিন্তু উত্তর বা পশ্চিম ভারতে দেখতে পাওয়া যায়। আকারে রুটির চেয়ে ছোট। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও শোনা যায় মৃণালিনী দেবী বানাতেন বিশেষ একরকম লুচি, যা ফুচকার মতোই আকারে ছোট। খাদ্যতত্ত্ববিশারদ কুরুশ দালাল মনে করেন, কেউ ছোট ছোট রাজ-কচুরি বানিয়েছিলেন, আর তা থেকেই ফুচকার জন্ম।
দ্রৌপদীর রন্ধনবিদ্যা নিয়ে যতই কিংবদন্তি চালু থাক, বিহার অঞ্চলের ফুচকাকে কিন্তু বলে বলে গোল দিতে পারে বাংলার ফুচকার স্বাদ। একই কথা খাটে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রেও। ফুচকার উৎপত্তি বিহারে হোক বা না হোক, ভারতের উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম, পূর্ব, যে কোনও অঞ্চলেই এর দেখা পাওয়া যাবে। মহারাষ্ট্রে এর নাম পানিপুরি, হরিয়ানাতে পানি পাতাশি, মধ্যপ্রদেশে ফুলকি। উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এর নাম গোলগাপ্পা। ওড়িশায় বলা হয় গুপচুপ, আর আসামে এর নাম ফুসকা। এক কথায় অষ্টোত্তর শতনাম। কিন্তু ফুচকারসিক মাত্রেই শুকনো ছোলা-মটরের ঘুগনি ভরা গোলগাপ্পা, পানিপুরিদের থেকে অনেক বেশি পছন্দ করেন পশ্চিমবঙ্গের আলুর পুর, ঘুগনি, আর নানারকম মশলা মেশানো গোল গোল ফুচকা। ওড়িশাতে আবার ফুচকার পুরের মধ্যে পেঁয়াজ মেশানো হয়। বাকি ভারতে ফুচকা একান্তভাবেই নিরামিষ, পেঁয়াজ-রসুনের সঙ্গে পর্যন্ত তার সম্পর্ক নেই। তবে কোনও কোনও অঞ্চলে তেঁতুলজলের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় পুদিনামিশ্রিত জল। বর্তমানে অবশ্য ফুচকাতেও ফিউশনের ছড়াছড়ি। দই ফুচকা, চাটনি ফুচকা তো ছিলই, এখন চকোলেট ফুচকা পর্যন্ত বাজারে এসে গিয়েছে। ফুচকা এখন আর কেবল রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে শালপাতায় খাওয়ার মতো গরিবি খাবার নয়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঝাঁ চকচকে মলেও এখন তার গতিবিধি অবাধ।