মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু গাজার একরত্তি শিশুর। যুদ্ধের শৈত্যে বিপর্যস্ত গাজায় চলছে রাজনীতি। চলছে শিশুমৃত্যু। শিশুর শীতল শব হাতে নিয়ে অসহায় অভিভাবকরা। দেখেও যেন দেখছে না বিশ্ব। এ সভ্যতা কি শিশুমৃত্যুতে লজ্জিত হতেও ভুলে গেল!
একরত্তি শিশু। রাতে আদর করে ঘুম পাড়িয়েছিলেন বাবা। সকালে আর কিছুতেই সে জাগছে না। তড়িঘড়ি সন্তানকে বুকে তুলে ছুটলেন হাসপাতালে। চিকিৎসক দেখেই বুঝলেন, শিশুটি আর এ পৃথিবীতে নেই। তীব্র শীতে পাড়ি দিয়েছে মৃত্যুর শীতল দেশে।
শিশুটি গাজার।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি-কে যখন এই কথা বলছেন শিশুটির পিতা মাহ্মুদ ফাসিহ্, সভ্যতা হয়তো শুনতে পাচ্ছে বুকফাটা আর্তনাদ। নাকি শুনতে পাচ্ছে না! বধির সভ্যতার কানে কোনও আর্তনাদই হয়তো শেষমেশ বেজে ওঠে না!
যুদ্ধের শৈত্যে গাজা বিপর্যস্ত। এবার এসেছে প্রকৃতির শীত। বৃষ্টির হাত ধরে। যুদ্ধের দিনে মাহমুদের পরিবারকে অন্তত বার দশেক ঠাঁইনাড়া হতে হয়েছে। তা তিনি মেনে নিয়েছিলেন। মেনেছিলেন সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবেই। এখন রাত কাটছে সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকায়। খাবার আর জলের নিয়মিত জোগান মেলে না। তার উপর আছে হু-হু শীত। সেই শীতেই মৃত্যু হচ্ছে একের পর এক শিশুর। মাহমুদের সন্তানকে পরীক্ষা করেই চিকিৎসক তা বুঝেছিলেন। চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হচ্ছে, হাইপোথারমিয়ার কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ প্রচণ্ড শীতে হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে একরত্তির। কিন্তু অভিভাবক করবেন কী! যন্ত্রণায় আকুল মাহমুদ জানিয়েছেন, যা তাঁর সম্বল ছিল তা দিয়েই শীত নিবারণের সব রকম চেষ্টা করেছেন তিনি। গরম পোশাক যতটুকু জোগাড় করতে পেরেছেন তার ওমে শিশুটিকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছিলেন, তবু শেষরক্ষা হল কই!
:আরও শুনুন :
জল পর্যন্ত নেই, মুঠো মুঠো ওষুধ খেয়ে পিরিয়ডস পিছোতে মরিয়া গাজার মহিলারা
শেষরক্ষা হচ্ছে না। কোল খালি হচ্ছে আরও অনেক অভিভাবকেরই। যুদ্ধে মৃত্যুপুরী গাজা যেন এখন প্রকৃতির রোষে। শুরু হয়েছে নতুন যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধ লড়ার রসদ কই! যাঁদের ঘর নেই, কোনক্রমে যাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু মাত্র সম্বল, তাঁরা কী করে এই শৈত্যপ্রবাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন সন্তানকে! জানেন না কেউই। আর বিশ্ব! রাষ্ট্রসংঘ বলছে সাহায্যের হাত বাড়ানো তো দূরের কথা, গাজাতে পৌঁছতেই বাঁধা দিচ্ছে ইজরায়েল। যথারীতি সে অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতি অতএব চলিতেছে শিশুমৃত্যুর মূল্যে। মানবাধিকার সংগঠন বলছে, যেভাবে হাসপাতালের উপর আক্রমণ চলছে, তা শুধু যুদ্ধপরাধ নয়, মানবিকতায় কালো দাগ। এর পালটা যুক্তি হল, হাসপাতালের দখল নিয়েছে হামাস। সে যুক্তি ভুয়ো বলে দাবি উঠেছে। দাবি আর পালটা দাবি চলছে তো চলছেই, আর বৃষ্টি-শীতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে এক এক করে শিশুরা। যে দৃশ্যে বিশ্ব-মানবতা লজ্জিত হতে পারত, তা শুধু খবর হয়ে উঠছে মাত্র।
:আরও শুনুন:
গাজায় নিহত স্ত্রী-সন্তান, চোখে জল নিয়েও বিশ্বকে ধ্বংসের খবর জানাতে অনড় সাংবাদিক
অতএব ফুলের মতো শিশুগুলো সব কোথায় গেল? না, এ প্রশ্ন যেন করেও সেভাবে করে উঠতে পারছে না এই বিশ্বের নিষ্ঠুর মানুষ। অসহায় বাবা মৃত সন্তানের শরীর বুকে আঁকড়ে চলেছেন কবরখানায়। মাথার উপর চক্কর কাটছে নজরদারি ড্রোন। বছর পেরিয়ে যায়। গাজার অবস্থা বদলায় না। কবে বদলাবে, তা-ও বোধহয় কেউ জানে না। যা ঘটছে তা বিশ্বের অজানা নয়। তবে সমাধানের পথ যেন এখনও মরীচিকা।
এই মৃত্যু-উপত্যকায় সন্তানের শীতল শব বুকে আঁকড়ে বসে থাকা ছাড়া যেন গাজার আর উপায় নেই। অসহায় বাবা অস্ফুটে শুধু বলছেন, কাছে মোবাইল নেই। বাচ্চাটির একটি ছবিও তুলে রাখা গেল না। আছে বলতে ছোট্ট দু-একটা পোশাক।
শুধু সে পোশাক আর কেউ কোনোদিন পরবে না।