সম্প্রতি অমৃত মহোৎসবের উদযাপন পেরিয়ে এসেছে দেশ। মিলেছে জ্ঞানে বিজ্ঞানে সমৃদ্ধিতে দেশকে জগৎসভায় সেরা করে তোলার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু স্বাধীনতার এত এত বছর পেরিয়েও খিদের ভারতবর্ষ বদলাল কই! কী ছবি ধরা পড়ল সাম্প্রতিক ক্ষুধা সূচকে?
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, যে মানুষ ক্ষুধার্ত, তার রুটিকেই কেবল ঈশ্বর বলে মনে হয়। পরাধীন ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দারিদ্র্য আর ক্ষুধার মাঝে দাঁড়িয়ে বাপু এ কথা বলেছিলেন। সেদিনের পর অনেকগুলো বছর কাটিয়ে এগিয়ে এসেছে দেশ। বিদেশি শাসকের শিকল ছিঁড়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। বিশ্বমঞ্চে অর্জন করেছে সম্মানও। কিন্তু খিদের ভারতের চেহারা বদলাল কই! আজকের ভারত পদে পদে ধর্ম নিয়ে ভাবিত, ধর্মের বিভেদ নিয়ে চুলচেরা তর্কে আর অসহিষ্ণুতায় ব্যস্ত, তবুও সে ভারতেও তো বহু মানুষের ঈশ্বর একই। তার নাম খিদে।
সম্প্রতি সামনে এসেছে চলতি বছরের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক। যেখানে ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৫ নম্বরে দাঁড়িয়ে আছে ভারত। এই সূচক জানাচ্ছে, অপুষ্টির হার এ দেশে ২৭.৩ শতাংশ। রিপোর্ট আরও বলছে, অপুষ্টির জনসংখ্যা যে দেশগুলিতে সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ভারত সপ্তম স্থানে। আর এই পরিস্থিতিকে রীতিমতো উদ্বেগজনক বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মহাত্মা গান্ধী যখন বলেন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে রুটিই ঈশ্বর, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা যখন পূর্ণিমা চাঁদকেই ঝলসানো রুটি বলে মনে করে, তখনকার ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট কিন্তু আলাদা ছিল। সে ভারতবর্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখে এসেছে। আবার সে ভারতবর্ষ ইংরেজশাসিত ভারত থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির ফলে তৈরি হওয়া দুর্ভিক্ষও দেখেছে। আমাদের মনে পড়ে যায় ‘নবান্ন’ লেখার প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে বিজন ভট্টাচার্যের সেই অভিজ্ঞতার কথা, যেখানে সারাদিনে সামান্য ফ্যান জোগাড় করতে পেরে তা-ই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলে মা নিজে। কিন্তু তারপরে? স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রে? সেই স্বাধীন মাটিতে আরও কয়েক দশক এগিয়ে এসেও, সেই একই খিদে জেগে থাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’-এ। যেখানে দিনের পর দিন খেতে না পাওয়া বৃদ্ধ, ডাক্তারের বদান্যতায় পাওয়া ভিটামিন ট্যাবলেট চিবিয়ে খায়। সেই না-খেতে পাওয়ার বিপন্নতায় ভাতের ডেকচি কেড়ে খেতে চায় মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পের সেই বানভাসি মানুষ।
শুধু সাহিত্যে নয়, বাস্তবেও যে এই খিদে একইরকম নির্মম সত্যি, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক সে কথাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই প্রথম নয়, বিগত কয়েক বছর ধরেই বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ২০২০ সালে ৯৪, ২০২১-এ ১০১, ২০২২ সালে ১০৭ হয়ে ২০২৩-এ র্যাঙ্কিং নেমেছিল ১১১-তে। এবার সেখান থেকে ১০৫ নম্বরে উঠে এলেও, দেশের পুষ্টির হারকে যে ভালো বলা চলে না তা তো বলাই বাহুল্য। গত বছরেই এই সূচক জানিয়েছিল, শিশুদের অপুষ্টির হার এ দেশে ১৮.৭ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ভারতে শিশুদের একটা বড় অংশ যে এখনও যথাযথ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অতি-শৈশবেই, সে বিষয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। পরিবারগুলিকে অর্থনৈতিক শ্রেণি অনুসারে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করলে দেখা যাচ্ছে যে, সর্বোচ্চ আয়ের কুড়ি শতাংশ পরিবারের মধ্যে বয়সের তুলনায় খর্বকায় শিশু যেখানে তেইশ শতাংশ, সেখানে দরিদ্রতম কুড়ি শতাংশের মধ্যে তা ছেচল্লিশ শতাংশেরও বেশি। অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদ অনুসারে অপুষ্টির চিত্রে এতখানি বৈষম্য বিশ্বের কম দেশেই দেখা যায়। যা এই ইঙ্গিতই করে যে, রেশন, অঙ্গনওয়াড়ি-সহ অন্য সরকারি সহায়তা প্রকল্পগুলি অতিদরিদ্র ও দরিদ্রদের যথাযথ সুরক্ষা হয়তো দিয়ে উঠতে পারছে না। যদিও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের রিপোর্টকে বারেবারেই উড়িয়ে দিয়ে চলেছে। ক্ষুধা সূচক নির্মাণের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক নাহয় থাকতেও পারে, তবে শিশু এবং সব স্তরের মানুষের মধ্যে জেগে থাকা এই খিদেকে তো উড়িয়ে দেওয়ার উপায় সত্যিই নেই। স্বাধীনতার এত বছর পরেও গান্ধীর উদ্বেগই যে ক্ষুধা সূচকে ফিরে এল, দেশের সমস্ত উন্নয়নের খতিয়ানেও সে লজ্জা ঢাকবে কি!