নারীর সম্মান তার যোনিতে রেখেছে কে! প্রশ্ন তুলেছিলেন নারী আন্দোলনের লড়াকু কর্মী কমলা ভাসিন। ধর্ষিতা মেয়ের উপরেই তো যাবতীয় লজ্জার দায় চাপিয়ে রাখে সমাজ। সেই লজ্জাকে অস্বীকার করেই দেশজুড়ে গরিমা যাত্রায় হেঁটেছিলেন নির্যাতিত নারীরা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে যাত্রার কথা।
পথ জুড়ে হাঁটছে মেয়েরা। হাঁটছে দেশজুড়ে। তাদের শরীর জুড়ে ক্ষতচিহ্ন। যৌন নির্যাতনের দগদগে ঘা। ধর্ষণের আঁচড় কামড়। সেইসব দাগের কথা সোচ্চারে বলতেই হাঁটছে তারা। বলছে, সব দাগ ভালো নয়। কিন্তু ভালো নয় বলেই দাগ লুকিয়ে রাখারও কোনও মানে নেই আসলে।
:আরও শুনুন:
নির্যাতনের দামে কেনা, তাই খোলা আকাশের অধিকার মেয়েদেরও
সেই দাগের কথা বলতেই ‘গরিমা যাত্রা’য় হাঁটতে শুরু করেছিলেন মেয়েরা। প্রায় পাঁচ হাজার যৌন নির্যাতনের শিকার মহিলা, তাঁদের আত্মীয়রা, সকলে মিলে হেঁটেছিলেন এই যাত্রায়। মাঝপথে কেউ জুড়ে গিয়েছেন, কেউ মাঝপথ থেকে ফিরেছেন, সব মিলিয়ে অন্তত হাজার পঁচিশ মানুষ এই যাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর, মুম্বাই-এর সোমাইয়া ময়দানে জড়ো হয়েছিলেন তাঁরা। মূলত প্রত্যন্ত ভারতের নিম্নবর্ণ, দলিত, আদিবাসী মহিলা। হাঁটতে হাঁটতে চব্বিশটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দুশোটি জেলা অতিক্রম করে যান তাঁরা। ব্যাঙ্গালোর, গোয়া, রায়পুর হয়ে, খড়গপুর ছুঁয়ে কলকাতার উপর দিয়ে পথ চলেন মেয়েরা। দশ হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে অবশেষে ২০১৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে পৌঁছয় এই মহামিছিল। এই মিছিলের লক্ষ্য ছিল মহিলা ও শিশুদের উপর ঘটে চলা যৌন নির্যাতন নির্মূল করা। পাশাপাশি যৌন নির্যাতনের ভুক্তভোগীদের অবস্থা সম্পর্কে সকলে জানুক, এও লক্ষ্য ছিল তাঁদের। আন্দোলনকারী মহিলারা চেয়েছিলেন, যৌন নির্যাতন নিয়ে আরও কথা হোক। যৌন নির্যাতন বিষয়ে সরকার যখন নীতি নির্ধারণ করবে, সে সময়ে নির্যাতিতাদের স্বরও উঠে আসুক। স্পষ্ট হোক তাঁদের চাওয়া আর না-পাওয়ার কথা।
আসলে, ধর্ষিতা বা নির্যাতিতাদের তো কোনও স্বর থাকতে নেই। সমাজ তো এমনটাই শিখিয়েছে আমাদের। যে কোনও হেনস্তা, ধর্ষণের ঘটনায় সবার প্রথমেই কয়েকটা আঙুল ঠিক উঠে আসে ধর্ষিতার দিকেই। তিনি কী পোশাক পরেছিলেন, ওই সময়ে ওই জায়গায় কী করছিলেন, ধর্ষককে আগে থেকে চিনতেন কি না, এমনই নানা প্রশ্ন করা হতে থাকে। সেইসব প্রশ্নের সূত্রেই দোষারোপের আগলও খুলে যায়। মেয়েরা জেনে যায়, যাই হয়ে যাক না কেন, দোষের দায়ভার প্রথমত এবং শেষত তারই। ফলে, ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ যে বা যারা করে, ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত বুক ফুলিয়েই ঘুরে বেড়ায় তারা। এমনকি ধরা পড়লেও অনুতাপের সুর মেলে না, বিলকিস বা নির্ভয়ার ধর্ষকদের কথা মনে করে দেখুন। উলটোদিকে নির্যাতিতার জন্য অন্ধ কুঠুরি বরাদ্দ করে সমাজ। চারদিকের অনেকগুলো চোখ তাকে ক্রমাগত বিঁধতে থাকে, তার শরীরে ধর্ষণের দাগ খুঁজে বেড়াতে থাকে।
:আরও শুনুন:
রাতের পথে কেবল ধর্ষকের অধিকার নাকি! বহু আগেই শুরু ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ আন্দোলনের
এই বাধ্যত নির্বাসনকেই নাকচ করতে চেয়ে ‘গরিমা যাত্রা’র ডাক উঠেছিল। যাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন অ্যাসিড হামলাকে হারিয়ে দেওয়া লক্ষ্মী আগরওয়াল। ছিলেন ভামরি দেবী, সদ্যোজাত মেয়েদের ‘বিয়ে’ আটকানোর সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যিনি গণধর্ষিতা হন, আর সেখান থেকেই এ দেশের কর্মক্ষেত্রে যৌন সুরক্ষা-সংক্রান্ত ‘বিশাখা গাইডলাইন’-এর সূচনা। তিনি বলেন, নির্যাতিতাকে যে নষ্ট মেয়ে কিংবা ডাইনি বলে দেগে দেওয়া যায় না, সে কথা বোঝানোর জন্যেই ‘গরিমা যাত্রা’। এই ‘যাত্রা’-র আহ্বায়ক আসিফ খান তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছিলেন, ২০১৮ সালের ‘স্পিক আউট’ সার্ভে অনুযায়ী ১৫০০০ জনের মধ্যে ১১৫০ জন বলেছিলেন, তাঁরা যৌন নির্যাতনের শিকার, ৬৪% বলেছিলেন নির্যাতক পূর্বপরিচিত, ২৮% বলেছিলেন যৌন নির্যাতন ঘটেছে নিজের বাড়ির মধ্যেই, ১০% বলেছিলেন, যৌন নির্যাতন ঘটেছে আত্মীয় বন্ধু বা প্রতিবেশীর বাড়িতে। এ ছাড়া ৬২% বলেছিলেন, তাঁরা যৌন অত্যাচারের পর কাউকেই জানতে দেননি, তিনি ধর্ষিতা।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, নির্যাতিতার নাম পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। এ নির্দেশের পিছনে যেমন ধর্ষিতার নিরাপত্তার কথা রয়েছে, তেমনই রয়েছে তাঁকে সামাজিক লজ্জা থেকে বাঁচাতে চাওয়া। যে সামাজিক নিয়ম ধর্ষিতাকে আরও কোণঠাসা করে, তাঁকে লজ্জা পেতেই বলে। সেই লজ্জা পেরিয়ে গরিমা বা আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার রয়েছে নির্যাতিতারও। সে কথাই বুঝিয়ে দিয়েছিল দেশের প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েদের এই ‘গরিমা যাত্রা’।