ফিনিক্স পাখির পালক ভরা ছিল হ্যারি পটারের জাদুদণ্ডে। ফুরিয়ে গিয়েও ফিরে আসার মন্ত্র। বাস্তবের দুনিয়ায় তেমনই এক জাদুকরকে চিনল এ প্রজন্ম, যাঁর ব্যাটের মধ্যেই ভরা আছে হলদে পাখির পালক। সে পালকের ছোঁয়ায় ফুরোল তেরো বছরের অপেক্ষা। আর ক্রিকেটের ‘ছোট’গল্পে রূপকথাই লিখে গেলেন ক্লাসিক কোহলি।
লিখলেন, অর্পণ গুপ্ত
২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে হিসেব কষে দেখলাম, এই তেরো বছরে, ভারত অন্তত খান দশেক আইসিসি-র বিভিন্ন নকআউট টুর্নামেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। এক চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বাদ দিলে, শত চেষ্টাতেও আর একখানা আইসিসি ট্রফি ঘরে আসেনি। আর গ্লোবালাইজেশনের পর যেমন উদার অর্থনীতিতে ভর করে ভারতের জনজীবন হুহু করে বদলাল, তেমনই গোলগাল, ক্লিনশেভড বিরাট কোহলি, যিনি কিনা ওই ওয়াংখেড়ের ফাইনালে একটা অদ্ভুত জোরালো ইনিংস খেলে দিয়েছিলেন, তাঁর কেরিয়ার গ্রাফখানা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে একেবারে আকাশ ছুঁল! ব্যক্তিগত রান-সেঞ্চুরির স্ট্যাটিসটিক্সে তাঁর সমকক্ষ এ নীল গোলকে এই মুহূর্তে আর কেউ নেই। উত্তুঙ্গ সম্ভাবনাময় তরুণ থেকে শ্রেষ্ঠতম ব্যাটার হয়ে ওঠার এই মার্গটায় বিরাট কোহলির জন্য জরুরি ছিল একটা আইসিসি ট্রফি। অথচ, এ কথা তো সত্য– বিরাটের বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে দেখার সৌভাগ্য ২০১১তেই হয়ে গিয়েছিল! কিন্তু, সে বিরাট কোহলি আর এই বিরাট কোহলির যে আশমান-জমিন ফারাক। শচীন তেণ্ডুলকরের কাছে সমস্ত অর্জনের পরে যেমন বিশ্বকাপটা একটা ভাত-ডালের নেসেসিটি হয়ে গিয়েছিল– বিরাট জানতেন, যতই তিনি ২০১১তে ট্রফি জিতে থাকুন, আজকের কিংবদন্তি বিরাট কোহলির কেরিয়ার পর্যালোচনার ক্ষেত্রে, শচীন-সহবাগ-জাহির-যুবি-গম্ভীরদের বিশ্বকাপখানা একটা ফুটনোট হয়েই থেকে যাবে। তাই নিজের রাজপাটের দণ্ড বেহাত হওয়ার আগে অপেক্ষা অপেক্ষা আর অপেক্ষা!
বিরাট যখন অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেন, তখন থেকেই যেন অপেক্ষার খিদে বাড়ল কয়েকগুণ৷ বার্বাডোজের ফাইনালের আগে, এ বিশ্বকাপে কোহলির ব্যাটিং গড় শোচনীয়, একশো রানও করতে পারেননি সর্বসাকুল্যে। বিরাট এ কথা নিশ্চিত জানতেন ও মানতেন যে, উপমহাদেশের তারকা সংস্কৃতি তাঁকে অমরত্ব দেবে এই ফাইনাল ম্যাচে কিছু করে দেখাতে পারলে। এ দেশে বিপননযোগ্য মহাতারকাদের একটি লক্ষ্য স্থির করে দেয় বাজার। বিরাটের ক্ষেত্রে সে লক্ষ্য ছিল আইসিসি ট্রফি! বিরাট ফাইনালে যে ইনিংসটি খেললেন, তা কি পরিস্থিতির বিচারে খুব উঁচু দরের? কেউ বলবেন হ্যাঁ, কেউ বলবেন না! কারণ, এই পিচে, যেখানে স্পিনারদের বলে তেমন টার্ন নেই, সেখানে বিরাটের স্ট্রাইক রেট একেবারেই আহামরি নয়! কিন্তু বহুকষ্টে কুড়িয়ে নেওয়া এই ছিয়াত্তর রান একটা খোয়াব। বিরাট কোহলির রান-রেকর্ডের ক্রিকেটীয় রিপোর্টকার্ডের বাইরে অক্রিকেটীয় কিসসা।
এত বছরের ক্লান্তির পর, বিরাট আজ ম্যাচের পর জড়িয়ে ধরলেন রোহিত শর্মাকে। অনেকক্ষণ চেপে রাখলেন বুকে। দুজনে দুজনকে। বিরাট জানেন,ব্যথার আদরে রেখে দেওয়া কত অবুঝ আঙুল, রাতবিরেতে ঘুম ভেঙে বুকের ভেতর হুহু করে ওঠা খোলা জানলার হাওয়া, পাশবালিশ খুঁজে বেড়ানো বেকার যুবকের কতদিনের না আসা ঘুম, ভোররাতে সব ঘন হয়ে নেমে আসে চোখের পাতায়। বিরাট কোহলি কার্যত সমস্ত ব্যক্তিগত খেতাবের মালিক হয়েও সেই গুগাবাবার হাল্লা রাজার মতো দুঃখী যেন; অপেক্ষা করে গেলেন এতকাল– আর সোনাদানায় ঠাসাঠাসি ভাঁড়ারের চাবি হারিয়ে আজ যেন সোনার গদি ছেড়ে মাঠে নেমে দু’হাতে মেখে নিলেন হাওয়া। আজ ভারত না জিতলেও বিরাট কোহলির ক্রিকেট রেকর্ডবুক এক চুল বদলে যেত না, আবার হয়তো বদলে যেত বহুকিছুই… আমরা দেখতেও পেতাম না! অবসর ঘোষণা সেখানে নিমিত্ত মাত্র– কোহলিজমের মোড়কে ঢাকা পড়ে যাওয়া এক ভয়ংকর অভিমান– বারে বারে চেয়েও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের কাছে ফিরতে না পারা কোহলি কেবলই এতদিন অপেক্ষা করেছেন এমন কোনও ব্রাহ্মমুহূর্তের!
অপেক্ষা যে কোথায় শেষ হয়, আর জীবন যে কোথায় শুরু হয়– তা কি কেউ জানতে পারে বোগিদাদা?