কোভিডের দরুন দুবছরে বারবার থমকে দাঁড়িয়েছে থিয়েটার জগৎ। শিল্পী-কলাকুশলীদের জীবিকা ও জীবন প্রশ্নের মুখে। এভাবে আর কতদিন? কী ভাবছেন নাটকের জগতের লোকজন?
থিয়েটার মানে তো শুধু অভিনেতা, অভিনেত্রী নন। আলো, মঞ্চ, মেকআপ, শব্দ প্রক্ষেপণের কাজ করেন এমন অনেকগুলো মানুষও জড়িয়ে এর সঙ্গে। প্রত্যেকেই এখন কর্মহীন। লকডাউনের বিধিনিষেধ হালকা হলেও থিয়েটার হল কবে খুলবে, কবে আবার নাটকের শো হবে, এই নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। তাই প্রেক্ষাগৃহের পর্দা এখনই উঠছে না। কীভাবে চলছে থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলোর?
আকাদেমি, রবীন্দ্র সদন, তপন থিয়েটার, গিরিশ মঞ্চ। কাউন্টারে টিকিট শেষ। শনি-রবিবার থিয়েটার হলের সামনের ছবিটা থাকত এরকমই। নতুন নাটক আসছে, খবরটা এসে যেত আগেই। প্রথম দিন প্রথম শো দেখতেই হবে। অফিসের ছুটিকে সঙ্গী করে এক দৌড়ে প্রেক্ষাগৃহে। শুধু অফিস কেন কলেজের ছেলে মেয়েদের মধ্যেও নাটক দেখাকে ঘিরে একই উন্মাদনা কাজ করত।
গত দেড় বছরে এই দিনগুলো অনেকবার এসেছে। কিন্তু থিয়েটার হলের সামনে সেই ভিড়টা আর নেই। নাটকের হোর্ডিংগুলোতেও ধুলো পড়ে গেছে। টিকিটঘর বন্ধ। কোভিড-১৯-এ শিল্পের যে মাধ্যম সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা হল থিয়েটার। সিনেমা তার বিকল্প পথ হিসাবে বেছে নিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে। কিন্তু থিয়েটার? তার তো কোনও বিকল্প নেই। তাই যাঁরা নাটক ভালবাসেন তাঁরা অপেক্ষায়, আবার কবে উঠবে ড্রপসিন।
পরিসংখ্যান বলছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর পরিস্থিতি এখন অনেকটাই আয়ত্তে। এবার কি উঠবে প্রেক্ষাগৃহের পর্দা? পর্দার নেপথ্যের ছবিটা এখন কেমন তার ইঙ্গিত দিলেন কৌশিক সেন। ‘সৌভ্রাতৃত্ব’ একটি সংস্থা, যেখানে কৌশিক সেন, দেবশঙ্কর হালদার, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, অরিন্দম গাঙ্গুলি, সীমা মুখোপাধ্যায় রয়েছেন। বিগত এক বছর ২০০ জন নেপথ্য কর্মীকে এই সংস্থা সাহায্য করেছে। এখনও করছে। তবে এভাবে বেশিদিন চললে সমস্যা আরও বাড়বে। মাঝখানে কিছুটা সময় আনলক হওয়ায়, কিছু নাটকের শো শুরু হয়েছিল। ‘স্বপ্নসন্ধানী’ জ্ঞানমঞ্চে মঞ্চস্থ করেছিল ‘কবির বন্ধুরা’। প্রথম শো হাউসফুল। পরের কয়েকটা শোয়ের ডেটও পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার মধ্যেই আবার লকডাউন। থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্পর্শ। নাটক চলাকালীন দর্শকের সঙ্গে মানসিক ও শারীরিকভাবে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। লাইভ দেখার মধ্যেই থাকে থিয়েটারের উত্তাপ। তাই থিয়েটারে ভার্চুয়াল বলে কিছু হয় না বলে মনে করেন কৌশিক সেন।
আরও শুনুন : বিপর্যয়ের দিনে মানুষের পাশে সেলেবরা
দলের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি চরম সমস্যায় পড়েছেন নেপথ্য শিল্পীরা। যাঁরা টেকনিশিয়ানস, যেমন মঞ্চসজ্জা-আলোর লোকজন, টিকিট বিক্রি করেন যাঁরা, এরকম আরও অনেকেই আছেন যাঁরা সরাসরি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে।
এখন প্রশ্ন, অতিমারী পেরিয়ে থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কী?
কৌশিক সেন মনে করেন, এই বিরতির মধ্যেই রয়েছে আশার আলো। নাটক হবে, শোও হাউসফুল হবে। তবে খুব ঝাঁ চকচকে শো করা যাবে না। শো হবে, তবে কম বাজেটে। থিয়েটারের মূল বিষয়টা দাঁড়িয়ে থাকবে কনটেন্ট ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের উপর।
করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝখানে অক্টোবর থেকে মার্চ টানা শো করেছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। কল্যাণী মুক্ত মঞ্চে ও আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসে শো করেছেন নতুন নাটক ‘একদিন মন্দিরে যাওয়ার পথে’। তিনি দেখেছেন,করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে মানুষ নাটক দেখতে এসেছেন। তাই অতিমারীর পরে থিয়েটারের ভবিষ্যৎ ও কলাকুশলীদের নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী দেবেশ চট্টোপাধ্যায়।
আরও শুনুন : করোনায় বন্ধ Live Show, গান শোনার আগ্রহ কি কমছে?
বর্তমান প্রজন্মের অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে থিয়েটার একটা আর্ট, যার একটা বোধের দিক থাকে। কোভিড-১৯-এর কারণে অন্যান্য মাধ্যমের মতো থিয়েটারের সঙ্গে যাঁরা জড়িয়ে তাঁদের অনেক দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। তবে এখন সময় হয়ে গেছে থিয়েটারের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র পাওয়ার। এটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভাল। খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করতে হবে।
এই প্রজন্মের কাছে অতিমারী পেরিয়ে থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কী?
ঋতব্রত মনে করেন, থিয়েটারের নিজস্ব দর্শক আছে। যাঁরা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের চাহিদাও খুব কম, তাই অতিমারির পরে থিয়েটারের আর্থিক সংকটে পড়ার সম্ভাবনা কম।
থিয়েটারের মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্পমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে তাঁদের দিকে যাঁরা পর্দার পিছনে থেকে কাজ করছেন। তবেই বাজবে থার্ড বেল। উঠবে নাটকের পর্দা।