লোকসভার আগে ‘ন্যায়পত্র’ নামেই নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ কংগ্রেসের। মোদি গ্যারান্টির উলটোদিকে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার গ্যারান্টিতে জোর দিচ্ছেন সোনিয়া-রাহুলরা। কিন্তু ভোটবাক্সে সে গ্যারান্টিতে কাজ হবে তো?
‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’-র সময় থেকেই ‘ন্যায়’ শব্দে জোর দিতে দেখা গিয়েছে কংগ্রেস শিবিরকে। এবার লোকসভা ভোটের আগে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশের সময়েও সেই ‘ন্যায়’-এর উপরেই নজর টানলেন সোনিয়া-রাহুলরা। ‘ন্যায়পত্র’ নামেই নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করে দেশবাসীকে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিল কংগ্রেস। যেসব প্রতিশ্রুতি স্বাভাবিকভাবেই মোদি সরকারের কাজ ও প্রতিশ্রুতির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ বিজেপির কার্যক্রমকে ‘অন্যায়’ বলে দাগিয়ে দিয়েই পালটা ন্যায়ের রাস্তা খুলে দেওয়ার ইঙ্গিত হাত শিবিরের। আর এই প্রস্তাবিত অবস্থাকেই খাড়গেরা আরও স্পষ্ট করলেন স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিয়ে। বুঝিয়ে দিলেন, বিজেপি দেশজুড়ে যে নয়া সংস্কৃতি নির্মাণ করে চলেছে, তা অন্যায্য, আর সেই কারণেই তা আশঙ্কার। সেই পরিস্থিতি থেকে স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিচ্ছে কংগ্রেস, ন্যায়পত্র প্রকাশ করে এই মর্মেই সরব হলেন রাহুলরা।
আরও শুনুন:
প্রধানমন্ত্রীর GYAN-এর পালটা বিরোধীর BAAP! ভোটের আগে কেন দাপাদাপি নয়া শব্দের?
এর আগে, ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’-র সময়েই, ন্যায় শব্দের প্রয়োগে নিজের রাজনীতি স্পষ্ট করেছিলেন রাহুল গান্ধী। কংগ্রেসের তরফে তিনি বোধহয় এ কথাই স্পষ্ট করে বলতে চেয়েছিলেন যে, দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই আসলে অধর্ম। ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্ম বলতে যা বোঝায়, তা তো কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আচারবিচার নয়, তা ন্যায় নীতি ন্যায্যতার মূল্যবোধও। সেই ধর্মের অর্থ গুলিয়ে দিয়ে, তাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ গণ্ডি টানলে যে অন্যায় হয়, রাহুল সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা পালটা বয়ান তৈরি করতে চাইছিলেন। পাশাপাশি তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, তিনি পথ হাঁটবেন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়ের লক্ষে। সেই ন্যায়ের অঙ্গীকারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যেন তৈরি কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী ইস্তাহার। দেশের সর্বত্র নানাভাবে যে বিভাজনকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, এবং উলটো স্বরকে দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে নানাভাবেই, সেই অবস্থা থেকে স্বাধীনতার কথাই বলছেন খাড়গেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, কথায় কথায় ভাবাবেগে আঘাত বা অবমাননার অভিযোগ তুলে যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, সেখান থেকে দেশকে মুক্ত করতে চান তাঁরা। কারও ব্যক্তিগত খাবার কিংবা পোশাকের নির্বাচনে তাঁরা মাথা ঘামাতে চান না, প্রেম বা বিয়ের অধিকারে নাক গলাতেও তাঁরা নারাজ। পাশাপাশি দেশের কোনও মানুষ দেশের যে কোনও স্থানে নিজের ইচ্ছেমতো যেতে পারেন বা থাকতে পারেন, এই স্বাধীনতাতেও তাঁরা বিশ্বাসী। আর যে সমস্ত আইনকানুন এই ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী, ক্ষমতায় এলে সেসব বিধানকে বাতিল করারই আশ্বাস কংগ্রেসের।
আরও শুনুন:
কংগ্রেসের বিরোধিতায় বেজায় সমস্যা! দলত্যাগীর ক্ষোভ কি মনে রাখবে দল?
‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’-র ভিত্তি হিসেবে আগেই পাঁচটি ন্যায়ের কথা জানিয়েছিলেন রাহুল। মহিলা, তরুণ, কৃষক, শ্রমিক এবং হিস্সাদারি বা জনসংখ্যা অনুযায়ী ক্ষমতায় অংশগ্রহণের ন্যায়ের দাবি তুলেছিলেন তিনি। কথা হচ্ছে, এর পরে পরে নরেন্দ্র মোদিও দেশের চার গোষ্ঠীর কথাই বলেন, গরিব, যুবা, কৃষক ও নারী। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে পাঁচ শরিকের জন্য কংগ্রেসের ন্যায়ের দাবি আর খুব বেশি করে আলাদা তাৎপর্য রাখছে কি? উপরন্তু কংগ্রেস একদিকে এই পাঁচ গোষ্ঠীর অধিকারের কথা বলছে, দাবি করছে জাতপাতের বিভাজন সরিয়ে ভোটদান, অন্যদিকে জাতিগণনা ও জাত সংরক্ষণের দাবিতে সওয়াল করে চলেছে, এই দুই অবস্থানের মধ্যেও স্ববিরোধ দেখছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। উলটোদিকে জাতশুমারির বিষয়টিকেই কার্যত নস্যাৎ করে মোদি সাফ বলেছেন, তাঁর উল্লিখিত চার গোষ্ঠীই দেশের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী বা জাত, যাদের স্বার্থ রক্ষা ছাড়া অন্য কোনও জাত নিয়ে তিনি ভাবিত নন। দেখা যাচ্ছে, আপাত নিরপেক্ষ এই কথার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কৃষক আন্দোলন নিয়ে নীরবতা কিংবা বিলকিস বা আসিফা কাণ্ডে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা। আপাত নিরপেক্ষতার আড়ালে সিএএ বা ইউসিসি-র মতো মোদি গ্যারান্টিগুলিও বাস্তব রূপ পেয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। পাচ্ছে বিপুল সমর্থনও। তাই প্রশ্ন ওঠে, যথার্থ নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে রাহুলরা যে পুরনো ভারতকে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছেন, জনমানসেও কি সেই ভূমি জেগে আছে আর? ইতিহাস বলে, দারিদ্র্য আর বেকারত্বে মার খাওয়া দেশ সবসময়েই আঁকড়ে ধরে দেশ-জাতি নিয়ে অহংকারকে। সুতরাং বিজেপির সযত্নে নির্মিত দেশের ধারণার যে পালটা বয়ান কংগ্রেস লিখতে চাইছে, এই সময়ে তা কি সহজ হবে? যে দেশ এই বাস্তবতাকে মেনেই নিচ্ছে, সেখানে এই বাস্তবতা থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি কংগ্রেসকে আর বাড়তি কোনও সুবিধা দেবে কি? সংশয় কিন্তু থেকেই যায়। আর ভোটেই মিলবে তার উত্তর।