আমিষে নিরামিষে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। কেবল খাবারের পছন্দে তফাত, নাকি আসলে এও আসলে আরেকভাবে বিভাজনেই জোর, দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি দেখে এই প্রশ্নই করছেন অনেকে। অথচ আমিষ খাওয়া নিয়ে এইসব বাদ-বিসংবাদের মধ্যেই নাকি দেশজুড়ে বাড়ছে মাছ খাওয়ার প্রবণতাও। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কথায় বলে, আপ রুচি খানা। হ্যাঁ, কেউ কী খাবার খাবেন, তা তাঁর নিজস্ব পছন্দ। কিন্তু সেই খাবার নিয়েই মাঝে মাঝেই বিতর্ক উসকে ওঠে দেশে। আর সাম্প্রতিক কালে সেই বিতর্কের মূল কেন্দ্রেই যেন এসে দাঁড়িয়েছে আমিষ আর নিরামিষের দ্বন্দ্ব। একাধিক ঘটনায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা আমিষ খান, খানিক বাঁকা চোখেই যেন দেখা হচ্ছে তাঁদের। এমনকি অনেকসময় সেই মনোভাব আর কেবলমাত্র কটাক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। যেমন সম্প্রতিই খোদ বিবেকানন্দকে নিশানা করে এক ধর্মগুরুর আক্রমণ ছিল, যে সিদ্ধপুরুষ, সে কখনও মাছ খায়? বাঙালির মাছ খাওয়া নিয়ে এই সুরে আক্রমণ ধেয়ে এসেছে বারে বারেই। যে আক্রমণের ভেতরে আদতে এক দেশ এক খাদ্য এই গণ্ডি টেনে দেওয়ার চেষ্টাই চোখে পড়ে। পুজোর সময় রান্নার তেলের বিজ্ঞাপনে কেন মাছ ভাজার ছবি দেখানো হবে, তা নিয়েও ঝড় উঠেছে। এমনকি শেষমেশ সেই বিজ্ঞাপনটি সরিয়েও নেয় সংস্থা। সম্প্রতি এক খাবার ডেলিভারি সংস্থা তো রীতিমতো আমিষ ও নিরামিষ খাবারের ডেলিভারির জন্য আলাদা পোশাকবিধি পর্যন্ত স্থির করে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ প্রবণতা বলছে, ভাগাভাগির মাত্রা এতটাই যে, কর্পোরেট সংস্থা পর্যন্ত এই বিভাজনকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। এই সবকিছু মিলেই যেন ক্রমশ দেশে এক বিভাজনের ন্যারেটিভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু আমিষ নিরামিষের এই সংঘাতের মধ্যেই এবার জানা গেল, নিরামিষ নয়, উলটে মাছ খাওয়ার প্রবণতাই বেড়েছে গোটা দেশ জুড়ে।
আরও শুনুন:
Hilsa: ইলিশ মাছকে নাকি সেকালে ভাবা হত ‘নিরামিষ’! কেন জানেন?
জাতীয় সংস্থার করা এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, বর্তমানে মাছ খাওয়ার দলে পড়েন দেশের ৭২.১ শতাংশ মানুষ। ২০০৫-২০০৬ সালের প্রেক্ষিতে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ ও তুলনা করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে দেশে মাছ খাওয়ার প্রবণতা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। যেখানে আগে মৎস্যপ্রেমী মানুষের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭৩ কোটির বেশি, শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৭ কোটিতে। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার প্রায় ৩২ শতাংশ।
আরও শুনুন:
আমিষ-নিরামিষে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ! বহু রূপে সম্মুখে ফিরছে জাতের ভাগাভাগিই?
‘ফিশ কনজাম্পশন ইন ইন্ডিয়া: প্যাটার্নস অ্যান্ড ট্রেন্ডস’ এই সমীক্ষাটি যৌথভাবে চালিয়েছিল ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ, কেন্দ্রীয় কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রক এবং ওয়ার্ল্ড ফিশ ইন্ডিয়া। কেন্দ্র সরকারের তত্ত্বাবধানে হওয়া এই সমীক্ষাই জানাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সম্পদ বৃদ্ধির ভিত্তিতে মাছ খাওয়ার চল বেড়েছে। ২০১৯-২০ সালের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, রোজ মাছ খান ৫.৯৫ শতাংশ মানুষ। সপ্তাহে অন্তত একদিন মাছ খান ৩৪.৮ শতাংশ মানুষ। আর কেবল উৎসব অনুষ্ঠানেই মাছ খেতে পারেন, এমন মানুষ মোট সংখ্যার ৩১.৩৫ শতাংশ। গ্রামের তুলনায় শহরে মাছ খাওয়ার হার বেশি, আবার নারীর তুলনায় পুরুষরাই দেখা যাচ্ছে বেশি মাছ খেয়ে থাকেন।
আরও শুনুন:
বাঙালির নাকি মাছ খাওয়া বারণ! কী বলছে পুরাণ?
এমনিতে মৎস্যপ্রেমের দৌলতে ‘মাছে ভাতে’ বলে বাঙালির সুনাম ও দুর্নাম দুইই আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি মাছ খাওয়ার দৌড়ে বাংলাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ত্রিপুরা। মাছ খাওয়ার নিরিখে সেরা এই রাজ্যে মাছ খান ৯৯.৩৫ শতাংশ মানুষ। পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির পাশাপাশি দক্ষিণের তামিলনাড়ু, কেরল ও গোয়াতে মৎস্যভুক মানুষের সংখ্যা রাজ্যগুলির জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি। উলটোদিকে গোবলয়ে এই হার অনেকটাই কম। রাজস্থান, পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে মাছ খাওয়া মানুষ ৩০ শতাংশের কম। এর মধ্যে হরিয়ানাতে এই হার সর্বনিম্ন, ২০.৫৫ শতাংশ। তবে এই ক’বছরের মধ্যে মাছ খাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জম্মু ও কাশ্মীরে। উপত্যকায় এই বৃদ্ধির হার প্রায় ২১ শতাংশ। সব মিলিয়ে একটা কথা কিন্তু বলা যায়। খাবারদাবারে বিভাজনের রেখা যতই মাথা তুলুক না কেন, খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে হয়তো এখনও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন দেশের অনেক মানুষই।