যে পশমিনা শাল নিয়ে আমরা মাতামাতি করি, কিংবা লাদাখে বাইক সফর নিয়ে যে আমাদের বিপুল উৎসাহ, সেই প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক জিনিসগুলিই বিপদের মুখে। আর তা বাঁচানোর জন্যই হিমাঙ্কের নিচে উষ্ণতায় একবিন্দু খাবার ছাড়া বসে রয়েছেন একজন মানুষ। অতন্দ্র প্রহরীর মতো। সেই দীর্ঘ লড়াইয়ে স্পটলাইটের উজ্জ্বলতা নেই, নেই দর্শকের হাততালিও।
সে এক আশ্চর্য পড়ুয়ার গল্প। প্রযুক্তিবিদ্যা নিয়ে সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে এলে কী হবে, বাঁধাধরা শিক্ষার বাঁধা পথে চলা তার নাপসন্দ। সমস্ত চলতি নিয়মকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সে নিজের জন্য নতুন পথ বানায়। আর সে পথ এমনই গন্তব্যে পৌঁছয় যে তার দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখতে হয় সকলকে। ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিতে এমনই এক আশ্চর্য মেধাবী ছাত্রের গল্প শুনিয়েছিলেন আমির খান। গোটা দেশ তুমুল ভালোবেসেছিল সেই এলোমেলো যুবককে। সংকটের মুখে সে নিজের মেধাকে কী অদ্ভুত উপায়ে কাজে লাগাতে পারে, তা দেখে বাহবা দিয়েছিল। সেসময়ে এ কথাও কারও অজানা ছিল না যে, এই র্যাঞ্চো কিংবা ফুংসুক ওয়াংড়ু কেবল সিনেমার চরিত্র নয়। বরং বাস্তবের একজন মানুষকে দেখেই তার গড়ে ওঠা। যাঁর নাম সোনম ওয়াংচুক।
-: আরও শুনুন :-
আমিষ-নিরামিষে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ! বহু রূপে সম্মুখে ফিরছে জাতের ভাগাভাগিই?
বর্তমানে অনশনে বসেছেন সেই ‘বাস্তবের র্যাঞ্চো’। এক পক্ষ পেরিয়ে গিয়েছে তাঁর অনশন। কিন্তু সে খবর কতটুকুই বা রেখেছি আমরা? কী কারণে অনশনের পথ ধরেছেন লাদাখের এই পরিবেশকর্মী, সে কথাও কি জানতে চেয়েছি? সোনম যখন প্রশ্ন তুলছেন, “আমাদের পাহাড়গুলোকে বিভিন্ন শিল্প সংস্থা আর আর খনি সংস্থার কাছে বেচে দেওয়াটাই লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার আসল উদ্দেশ্য নয় তো?’’ তার উত্তরে মুখে কুলুপ এঁটে আছে দেশের সেই অংশই, যারা পর্দার র্যাঞ্চোকে হাততালিতে ভরিয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি।
আসলে ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্বীকৃতি মেলার পর লাদাখ আশ্বস্ত হয়েছিল। সেই সময়েই মোদি সরকারের তরফে আরও আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, অচিরেই লাদাখ অঞ্চলকে ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু তারপর দিন গড়াতে গড়াতে আরও একটি লোকসভা নির্বাচন আসন্ন, অথচ প্রতিশ্রুতি রয়েছে প্রতিশ্রুতির জায়গাতেই। সেখানেই লাদাখের অধিবাসীদের হয়ে সোনম প্রশ্ন তুলছেন, যেখানে ৫০ শতাংশের বেশি আদিবাসী-জনজাতি জনসংখ্যা থাকলেই কোনও অঞ্চল ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, সেখানে লাদাখে মোট জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশেরও বেশি মানুষ আদিবাসী-জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত হলেও তা নিয়ে সরকারের এহেন গড়িমসি কেন?
-: আরও শুনুন :-
World Water Day: অবাক জলপান! জলের দরে আর মেলে না জল
কথা হল, পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা এবং ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে লাদাখ বেশ কিছুদিন ধরেই সরব। কিন্তু সোনম ওয়াংচুক কেবল এই রাজনৈতিক দাবি নিয়েই অনশনে বসেননি। এর আড়ালে লাদাখের পাহাড়-পরিবেশের উপর কী কোপ নেমে আসতে পারে, সেই দিকটিই তিনি স্পষ্ট করে দিতে চাইছেন। তিনি সাফ বলছেন, গোটা দেশ জুড়ে যে বিকাশের বুলডোজার চলছে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার পর তার বড়সড় আঁচ এসে পড়েছে লাদাখেও। পরিবেশভাবনার ছিটেফোঁটা না রেখেও যেভাবে পুঁজি আর শিল্পের অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে সেখানে, তাতে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে লাদাখের প্রকৃতি। বিভিন্ন প্রকল্পের ফলে উৎখাত হতে হচ্ছে জনজাতির মানুষকেও। যেমন ধরা যাক, সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য লাদাখের চাংথাং অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যে অঞ্চলকে ভেড়ার চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করতেন এখানকার চাংপা সম্প্রদায়। পশমিনার মূল উৎপাদক এঁরাই। সোনম জানিয়েছেন, লাদাখে ভূগর্ভ থেকে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এতদিনকার ট্র্যাডিশন অনুযায়ী সেই খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ক্ষেত্রেও পরিবেশের কথা মাথায় রাখবে না কেউ। যার জেরে বিস্তীর্ণ লাদাখের গোটা বাস্তুতন্ত্র ঘোর সংকটের মুখে পড়বে, হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন ম্যাগসেসে সম্মানে ভূষিত বাস্তবের র্যাঞ্চো।
বুঝতেই পারছেন, যে পশমিনা শাল নিয়ে আমরা মাতামাতি করি, কিংবা লাদাখে বাইক সফর নিয়ে যে আমাদের বিপুল উৎসাহ, সেই প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক জিনিসগুলিই বিপদের মুখে। আর তা বাঁচানোর জন্যই হিমাঙ্কের নিচে উষ্ণতায় একবিন্দু খাবার ছাড়া বসে রয়েছেন একজন মানুষ। অতন্দ্র প্রহরীর মতো। নিজেদের যাবতীয় সুখের জন্য যে পরিবেশকে আমরা রোজ নিংড়ে নিই, নিজের সমস্ত সুখকে বিদায় জানিয়ে সেই পরিবেশকে দুহাতে আগলে রাখতে চাইছেন তিনি। সেই দীর্ঘ লড়াইয়ে স্পটলাইটের উজ্জ্বলতা নেই, নেই দর্শকের হাততালিও। র্যাঞ্চোকে নিয়ে আমাদের বীরপূজা সিনেমার স্ক্রিনের মাপেই আটকে যাবে। সেই আলোর বৃত্তের বাইরে একাই বসে থাকবেন সোনম ওয়াংচুক। বাস্তবের নায়ক হয়ে।