জীবনে দুঃখ আছে। বলা হয়, এ জীবন দুঃখময়। ত্রিবিধ তাপ অহরহ আমাদের দগ্ধ করছে। আমরা যদি দুঃখের কারণ জানতে পারি, তাহলেই দুঃখ নিবারণও সম্ভব। শোনাচ্ছেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।
দুঃখ আমাদের নিত্যসঙ্গী। জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি এসে ঘিরে ধরে আমাদের জীবন। দুঃখ থেকে আমাদের তাই সহজে পরিত্রাণ মেলে না। কিন্তু যদি কাতর হয়ে দিন কাটিয়ে ফেলি, তবে দিনের দিন কেটেই যাবে। শ্রী গীতা জ্ঞানের লক্ষণ হিসেবে যে যে বিষয় স্থির করেছেন, তার মধ্যে আছে – জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-দুঃখ-দোষ-অনুদর্শনম্॥ – অর্থাৎ এগুলির কারণ অনুসন্ধান করাই জ্ঞান, না করাই অজ্ঞানের লক্ষণ। দুঃখ অতিক্রম করতে তাই আমাদের পৌঁছাতে হবে দুঃখের কারণে।
ভারতের দর্শনসমূহ দুঃখ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজেছে বহুকাল ধরেই। বৌদ্ধ দর্শনের মূলেও আছে এই দুঃখবাদ। ভগবান বুদ্ধ যে চতুরঙ্গ আর্যসত্য আমাদের উপহার দিয়েছিলেন, তার প্রথমটিই হল দুঃখের অস্তিত্ব স্বীকার করা।
কীরকম এই দুঃখ? বলা হয়, জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ। সেই সঙ্গে অপ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ দুঃখ, প্রিয়জনের বিয়োগ দুঃখ, যা ঈপ্সিত তা না-পাওয়া বা অপ্রাপ্তিও দুঃখ। এই যে নানাবিধ দুঃখ আছে আমাদের জীবনের চারপাশে, সেই দুঃখের অস্তিত্ব আমাদের গোড়াতেই স্বীকার করে নিতে হবে। দুঃখকে দর্শনই দুঃখ অতিক্রমের প্রথম সোপান।
দ্বিতীয় আর্যসত্য আমাদের জানাচ্ছে, দুঃখের কারণ অনুসন্ধান করতে। কোথা থেকে আসে এই দুঃখ? এর উৎস হল আমাদের তৃষ্ণা। কামনা ও বাসনা। কামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা, বিভবতৃষ্ণা – নানাবিধ তৃষ্ণা আমাদের দুঃখমুখে চালিত করে। তৃতীয় আর্যসত্য তাই বলছে, দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব যদি এই তৃষ্ণা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তৃষ্ণার প্রতি বিরাগ, তৃষ্ণা রোধ এবং তৃষ্ণা ত্যাগের মধ্য দিয়েই দুঃখ থেকে পরিত্রাণ মিলবে। এই যে কামনা বাসনা আমাদের দুঃখের কারণ, তার উৎপত্তির মূলে আবার আছে অহং জ্ঞান। অর্থাৎ সেই আমির উপস্থিতি। যে আমিত্বকে সরিয়ে রেখে কর্ম সম্পাদনের উপদেশ আমাদের দিয়ে থাকেন শ্রী গীতা। সর্বভূতের জন্য যখন আমাদের কর্ম নিবেদিত হবে, তখনই এই আমির বিনাশ সম্ভব। আর অহংনাশ হলেই পথ খুলে যাবে বাসনামুক্তির।
এবার তাহলে আমাদের সন্ধান চালিত হল বাসনামুক্তির পথে। কেমন সেই পথ? কোন পথ ধরে এগোলে বাসনার বিষ পরিত্যাগ করা সম্ভব। তারই সন্ধান দিচ্ছে চতুর্থ আর্যসত্য। এখানে এসে আমরা পাই অষ্টাঙ্গ মার্গের খোঁজ। এই পথ ধরেই বাসনার হাত থেকে আমাদের মুক্তি মেলে। অতএব এইখানে আমরা একে একে চিনে নেব সেই উপায় বা পথগুলিকে। পথগুলি হল – সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্, সম্যক কর্ম, সৎপথে জীবিকা অর্জন, সম্যক উদ্যম, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি। এর অনুশীলন সহজ নয়। বহু আয়াসে নিজের মনকে এর জন্য প্রস্তুত করতে হয়। আর তার জন্য আছে শীল-সাধনের বিধান। বৌদ্ধধর্মে যে পঞ্চশীল-এর কথা বলা হয়েছে, তাতে একটু একটু করে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলা যায়। এই শীল সাধনের গোড়াতেই বলা হচ্ছে অহিংসার কথা। অর্থাৎ, অন্য প্রাণীকে হত্যা না-করা। দ্বিতীয় হল, অচৌর্য বা চুরি না করা। এই শিক্ষায় নিজের লোভ সংবরণ করা সম্ভব হয়। তৃতীয়টি হল, ইন্দ্রিয়সংযম। চতুর্থ বিধান হল মিথ্যা কথা না-বলা বা সত্যভাষণ। পঞ্চমটি হল মাদকদ্রব্য বর্জন। এই পঞ্চ-শীল যদি কেউ নিয়ত জীবনে অভ্যাস করেন তবে তাঁর মন হয় উন্নত। সেই উন্নত মনই ক্রমে আমিত্ব বর্জন করে অহং-এর বেড়াজাল থেকে মুক্তি খুঁজে নিতে পারে। কামনা বাসনার তৃষ্ণা লোপ পায় তখনই। আসলে যা আমাদের মুক্তি দেয় দুঃখ থেকেই।
তাই এ জগৎ দুঃখময় বলে দুঃখ করে বসে থাকতে নেই। বরং প্রকৃত জ্ঞানীর মতো দুঃখ নিয়ে চর্চা করলেই দুঃখের মূলে পৌঁছানো যায়। আর নানাবিধ উপায়ে সেই মূলটুকু সরিয়ে দিতে পারলেই একদিন দুঃখের হাত থেকে আমাদের মুক্তি মেলে। আমরা উপলব্ধি করি, জগতের আনন্দযজ্ঞে আমাদেরও আছে নিমন্ত্রণ।