মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র। বাংলার প্রদেশে প্রদেশে তিনি জড়িয়ে আছেন বহু রূপে, বহুত্বের স্বরূপে। তারই সন্ধানে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘রামচরিত’।
আদর্শপুরুষের প্রতিমা হিসেবে যে রামকে নির্মাণ করেছিল রামায়ণ, সেই রামায়ণই আবার বালীবধের ঘটনায় মর্যাদা পুরুষোত্তমকে প্রশ্ন করার পরিসরও তৈরি করেছিল। রাম অথবা কৃষ্ণ, কেউই যে আসলে প্রশ্নের অতীত নন, নীতি ও ন্যায্যতার বিচারেই সে সত্যকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল মহাকাব্য। প্রশ্নাতীত আনুগত্যের বিপরীতে রামায়ণের এই অবস্থানকে চিহ্নিত করলেন সরোজ দরবার।
মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র, তিনি নরচন্দ্রমা। ভারতবর্ষের চিরন্তন আদর্শ-আকাঙ্ক্ষার শাশ্বত রূপায়ণ। মহাকাব্যের কবি তাঁকে আদর্শের যে চূড়ান্ত রূপ হয় এবং হতে পারে– তার কাছাকাছিই পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। ফলে রামকে সময়বিশেষে এমন অনেক কাজ করতে হয়েছে, যার দরুন টোল খেয়েছে আদর্শপুরুষের প্রতিমাও। ফলত রামচরিত্রের বিশেষত্ব এই যে, তা নিরেট, নিশ্ছিদ্র নয়। তাঁকে যত খতিয়ে দেখা যায়, তত প্রশ্ন করা যায়। এবং সেই সাপেক্ষে রামের যুক্তিগুলি যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে নীতি-ধর্মের দ্বান্দ্বিক পরিসরগুলি আমাদের সামনে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহাকাব্যিক বিস্তারে রামচরিত্র যুগে যুগে যে ব্যঞ্জনায় ধরা দিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ তাকেই বলেছেন, ‘পরিপূর্ণ মানবের আদর্শচরিত’। তবে সেই রামচরিত একেবারে প্রশ্নহীন নয়; তার মধ্যে বিরোধাভাসের সূত্রগুলি থেকে যায়। এবং এই যে ‘বিরোধের মধ্যে শান্তি’, ‘পরিপূর্ণ পরিণামের মধ্যে সমস্ত খণ্ডতার সুষমা’, তাই-ই আসলে রামকে মহাকাব্যিক গৌরব দান করেছে। রাম এবং ভারতবর্ষের আত্মা তাই এক-ই। সেখানে প্রশ্নের জায়গা আছে। সমালোচনার পরিসর আছে। নীতির সংকট দেখা দিলে, ধর্মের চ্যুতি হলে নীরব হয়ে থাকার বিধান নেই।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: শস্যের রূপকে রাম-সীতা ভাই-বোন, রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ মানুষের যন্ত্রণার কাব্য
মহাভারতের কবিই রামকে এই সমালোচনার পরিসরে টেনে এনেছেন। ‘অশ্বথামা হতঃ ইতি কুঞ্জরঃ’ বলে দ্রোণাচার্য বধে ভূমিকা নিয়েছেন যুধিষ্ঠির। নেপথ্যে যুক্তির সলতে পাকিয়েছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। তিনি ধর্মপুত্রকে দ্রোণবধের যে যুক্তিকাঠামো বুঝিয়েছিলেন তার ফলশ্রুতিতেই যুধিষ্ঠিরের এই মিথ্যাভাষণ কিংবা অর্ধসত্যের মাধ্যমে কাজ হাসিল। কাজটি যে গর্হিত এবং দূষণীয় তা নিয়ে মহাকবির মনে কোনও সন্দেহই ছিল না। অতএব এই কাজটির সমালোচনা করতেও তিনি ছাড়লেন না। মহাকাব্যে সেই সমালোচনার দায়িত্ব নিলেন অর্জুন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিনি আগাগোড়াই প্রশ্নহীন নন। একেবারে যুদ্ধের শুরুতেই তিনি যে মোক্ষম প্রশ্নটি তুলেছিলেন, আস্ত গীতা ব্যাখ্যান করে তবে কৃষ্ণকে তা সামাল দিতে হয়েছে। বহু যুগের এপার থেকেও আমরা বুঝতে পারি, অর্জুন চরিত্রের ছিল যুক্তিবাদী মন, যা চূড়ান্ত কর্তৃত্বের মুখেও প্রশ্ন করতে জানত। সেইসব প্রশ্নের উৎস নীতি, অর্জুন মানবতাবাদী নৈতিকতায় বিশ্বাস করতেন বলেই যুদ্ধের পরিণাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এবং এখানেও যখন অর্ধসত্যের কূট প্রয়োগে আচার্য হত্যা হল, তখনও তিনি স্তব্ধবাক হয়ে থাকলেন না। মহাভারতের কবি, অর্জুনের মুখে ভাষা জুগিয়ে জগৎকে শুনিয়ে দিলেন, ‘বালীবধের জন্য রামের যেমন অকীর্তি হয়েছে সেইরূপ দ্রোণবধের জন্য আপনার চিরস্থায়ী অকীর্তি হবে।’ মনে রাখা ভালো, দ্রোণবধের পিছনে মুখ্য ভূমিকা কৃষ্ণ এবং যুধিষ্ঠিরের। এবং সেখানেও পাণ্ডবপক্ষের জয়, জীবনরক্ষার মতো বিষয়ও জড়িয়ে আছে। তার পরেও অর্জুন এই ‘অকীর্তির কালিমা’ চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করলেন না। এবং বাস্তবিকই এই কালিমার সূত্র ধরেই মহাকাব্যের নীতির সংকটে পৌঁছনো যায়। ঠিক সে সংকটে পড়তে হয়েছিল রামচন্দ্রকে।
এই সংকট নানা পরতে খুলে গিয়ে রামকে কখনও উত্তর দিতে বাধ্য করেছে, কখনও আবার একেবারে নিরুত্তর করে দিয়েছে। আদর্শপুরুষ হওয়ার দরুনই রামচন্দ্র পরমবীর-ও বটে। অথচ বালীকে যেভাবে তিনি বধ করেছেন, তা কিছুতেই অনুমোদন করতে পারেননি মহাকবি। কৃত্তিবাস পর্যন্ত বিষাদের দোহাই দিয়েও এই কাজকে রামের ‘প্রমাদ’ বলতেই বাধ্য হচ্ছেন। আর ভক্ত তুলসীদাস যদিও বালীর ঈশ্বরলাভ ইত্যাদির প্রসঙ্গ টেনে ভক্তি দিয়ে খানিকটা আড়াল করতে চেয়েছেন, তবু এই ঘটনাকে তিনিও এড়িয়ে যেতে পারছেন না। বালীর দোষটা কোথায়? না, তিনি বলপূর্বক ভ্রাতৃবধূকে অপহরণ করে এনে অঙ্কশায়িনী করেছেন। এদিকে রাম নিজে পিতৃসত্য পালনের জন্য বনবাস স্বীকার করে নিচ্ছেন, ওদিকে সীতার প্রতি লক্ষ্মণ যে ব্যবহার করছেন, তার সমান্তরালেই বালীর এই কাজ অন্যায় বলেই বোধ হবে। রামেরও তাই-ই হয়েছে। তবে, এ-কথাও তো ঠিক যে সভ্যতার যে আলো-হাওয়া থেকে রামচরিত্র পুষ্টিলাভ করেছে, তা বালীর জন্য প্রযোজ্য নয়। দুজনের সংস্কৃতি একরকম নয়; অথচ রাম তাঁর নিজের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের বশেই অন্যের বিচার করেছেন। তবু যা সর্বজনীন ভাবে মহৎ, তা সভ্যতানিরপেক্ষ ভাবেই সত্য। সংস্কৃতি অন্য বলে নিন্দনীয় কাজ তো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। সেই হেতু বালীবধের পক্ষে রামের প্রথম যুক্তি এই যে, যেহেতু বালী গর্হিত কাজ করেছেন তাই রাজপ্রতিনিধি হিসাবে তিনি তাঁর শাস্তি বিধান করেছেন। মোটের উপর এ হল অন্যায়ের প্রতিবাদ গোছের একটি যুক্তি, তবে রাম নিজেও বোধহয় জানতেন যে, তা তেমন পোক্ত নয়। কেননা এই একই দোষে দুষ্ট সুগ্রীব, যাঁর সঙ্গে তিনি মিত্রতা পাতিয়েছেন। বালীর জন্য এই শাস্তি বরাদ্দ থাকলে, সুগ্রীবও ছাড় পেতে পারেন না। অতএব নিজের যুক্তি তেমন জোরালো নয় জেনেই সম্ভবত তিনি আরও যুক্তি রচনা করলেন। সুগ্রীব যেহেতু রামের বন্ধু, আর সুগ্রীবের সঙ্গে বালীর দ্বন্দ্ব, সেই হেতু রাম আসলে বধ করেছেন মিত্রের শত্রুকে। তাতে অধর্ম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই যুক্তিতে ধর্ম নয় রক্ষিত হল; তবে সুগ্রীবের সঙ্গে রামের বন্ধুত্বের কারণটা হল সীতা উদ্ধার। অর্থাৎ এই গোটা বিষয়টার মধ্য্যেই থেকে গেল তীব্র স্বার্থগন্ধ, এবং সেই কারণেই একটি হত্যা কি আদৌ সমর্থনযোগ্য? মহাকবি নিজেও যেন এতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। বা, বলা যায় যাঁরা রামায়ণ রচনা করছিলেন, তাঁরা যেন একমত হতে পারছেন না। অতএব আরও যুক্তি সাজাতে হচ্ছে। সর্বোপরি বালীকে বধ করা হয়েছে পিছন থেকে, অতর্কিত আক্রমণে; বীরের ধর্মও তো তাতে রক্ষিত হয় না। তখন রামের যুক্তি মাত্র এই যে, বালী তো বানর অর্থাৎ শাখামৃগ; সেক্ষত্রে এই ধরনের বধ দোষের নয়। কেননা ক্ষত্রিয়রা এভাবেই মৃগয়া করে থাকেন। এইখানে এসে আমাদের ধন্দ জাগে। রামায়ণের কবিরা যুক্তি সাজাচ্ছেন বটে, হয়তো তাঁদের নিজেদের মতানৈক্য কাটাতেই, তবে তা রামকে ঠেলে দিল আরও বিপন্নতায়। সত্যি বলতে, এই তৃতীয় যুক্তিতে এসে রাম একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। কেননা তাঁর বলার মতো কিছু নেই। বালীবধ মোটেও মৃগয়া নয়। আর এই বানরদের সঙ্গেই তো রামচন্দ্র মিত্রতা করছেন সীতা উদ্ধারের জন্য। অতএব বানর বলেই বালী পিছন হতে বধ্য, এ যুক্তি যেমন ক্ষীণ তেমনই হীন। মহাকাব্য দেখাতে শুরু করল যে, যা অন্যায় তা অন্যায়। হাজার যুক্তি দিয়েও সেই বালির বাঁধ রক্ষা করা যায় না।
সর্বজনীন মানবতাবোধ রামের এই কাজকে চিরকাল প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে এবং ফিরিয়ে আনবে নৈতিকতার কাছে। যদিও শেষ পর্যন্ত রাম এ কাজের জন্য অনুতপ্ত হননি। শম্বুক বধের ক্ষেত্রেও রামের ব্যবহার একই। তবে পরবর্তীকালে যুধিষ্ঠির দ্রোণবধের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছেন। রাম এবং যুধিষ্ঠিরের অকীর্তির কথা একযোগে বলতে কুণ্ঠাবোধ করছেন না অর্জুন। মহাকাব্যের মহিমা এইখানেই। যদিও রাম বলছেন যে, ধর্মের কারণেই তিনি বালীকে বধ করেছেন, তবু তাঁর যুক্তিকে একেবারে প্রশ্নাতীত আনুগত্যে মেনে নেওয়া হয়নি। খতিয়ে দেখা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত এই বিচারে পৌঁছনো গিয়েছে যে ধর্মের যুক্তি সেখানে তেমন পাকা নয়। পরবর্তী যুগ তাই একইরকম ঘটনায় অন্তত অনুতাপ পর্যন্ত পৌঁছেছে। বলা যায়, এই উত্তরণের সূচনা রাম চরিত্রের মধ্যেই নিহিত, আর তাই তা যুগে যুগে স্মরণযোগ্য।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: যুদ্ধের দিনে প্রেম… কম্বনের রামায়ণ যেন ব্যক্তিগত ঈশ্বরীতলার রূপকথা
রামের মূর্তি গড়ে যখন পূজা করার উপলক্ষ্য তৈরি হয়, তখন আসলে দেবত্বের আরোপে আমরা তাঁকে প্রশ্নের অতীত করে তুলি। মহাকাব্যের অভিপ্রায় সম্ভবত সেরকম ছিল না, এই যা আক্ষেপের।