মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র। বাংলার প্রদেশে প্রদেশে তিনি জড়িয়ে আছেন বহু রূপে, বহুত্বের স্বরূপে। তারই সন্ধানে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘রামচরিত’।
এই পর্বে থাকল দক্ষিণের কবি কম্বনের রাম-দর্শন, যেখানে কাব্য হয়ে উঠেছে ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংলাপ। প্রেমের উদ্ভাসই সেখানে মুখ্য, যুদ্ধের দিনে প্রেমই সে কাব্যকে দিয়েছে অনন্যতার আস্বাদ।
লিখছেন, তিতাস রায় বর্মণ।
The Ramayana does not belong to any one moment in history for it has its own history which lies embedded in many versions which were woven around the theme at different times. – রোমিলা থাপার
মহাকাব্য আসলে এক ঐতিহাসিক চেতনা। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি কথা, ইতিহাস নয়। ইতিহাসের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই, ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয়ও নেই। পরিচয় রয়েছে অতীতের সঙ্গে, অতীতের বোধের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে। যে চেতনা এক কবির, এক স্বপ্নদ্রষ্টার, এক ভাবুক মনের। কোনও একজন কবির নয়, বহু কবির বোধ যেখানে মিলেমিশে রয়েছে। দীর্ঘ এক বহমান সময়ের জলছবি যেখানে আঁকা। যেখানে একজন কবি অনুপ্রাণিত করেন আরেক কবিকে। যেখানে এক কবি জন্ম দেন আরেক কবিকে। মহাকাব্য আসলে যৌথ কাব্য, যেখানে প্রশ্রয় দেওয়া বহু কবির অফুরন্ত কল্পনাশক্তিকে। যেখানে এসে যুক্ত হয় স্থান-কাল-পাত্রের রসায়নও।
কখনও ভৌগোলিক অবস্থান বদলে দেয় কাব্যের গতিকে। কখনও লোকনীতি, রাজনীতি খেলা করে কাব্যের চরিত্র বদলে। তাই মহাকাব্য গোটা দেশের মানুষের হাতে তৈরি। মহানায়ক তৈরি গোটা দেশের এক বৃহত্তর শুভবোধ থেকে। যেখানে মহানায়কের চরিত্র ধারণ করে দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকায়ত গুণ।
তাই রামায়ণে রাম কখনও মানুষ, কখনও দেবতা। কখনও বিষ্ণুর অবতার, কখনও গৌতম বুদ্ধের অবতার। কখনও সীতা রামের স্ত্রী, কখনও রাম-সীতা ভাই-বোন, কখনও সূর্পণখা অতীব সুন্দরী, কখনও সে কুৎসিত। কখনও রাম-সীতার সম্বন্ধ করে বিয়ে, কখনও তাদের প্রথম সাক্ষাতে প্রেম। কখনও রাবণ প্রধান চরিত্র, নায়ক, কখনও রাবণ খলনায়ক। কখনও রাম নিরামিষাশী, কখনও আমিষভক্ষণকারী।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: বাংলার আছে নিজস্ব ‘অযোধ্যা’, এখনও বইছে ক্ষীণস্রোতা ‘সরযূ’
যখন ভারতের একটিমাত্র অঞ্চল রামায়ণকে কুক্ষিগত করে রেখেছে, ইতিহাসের সঙ্গে কাব্যের সম্পর্ক খুঁজছে, যখন বর্তমানের নকশা বদলে দিতে চাইছে, চাইছে দেশের মানুষের চেতনায় হামলা করতে, মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়তে, ধর্মের নামে লাশ ফেলতে, তখন এই দেশেরই ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে তুলে আনতে হয় রামায়ণকে, রামায়ণের বিবিধ চিন্তাধারাকে মূলস্রোতে নিয়ে এসে মহাকাব্যকে মুক্ত করতে হয় সাহিত্যের আঙিনায়।
১৩টি ভারতীয় ভাষায় রামায়ণ লেখা হয়েছে, রয়েছে রামায়ণের অসংখ্য লোকভাষ্য। প্রতিটি আলাদা, প্রতিটি নিজস্ব ভঙ্গিমায় গর্বিত। আমার দেশ যেহেতু রামকে শুধুমাত্র উত্তর ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে, রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি হিসাবে অযোধ্যাকেই শুধু স্থানমাহাত্ম্য দান করেছে, তাই আমাদের ওপরেই দায়িত্ব এসে পড়ে দক্ষিণ ভারতের রামকে চর্চায় নিয়ে আসার। রামের অন্য পাঠ-কে সমসাময়িক করে তোলার।
১২০০ খ্রিস্টাব্দে তামিল কবি কম্বন-এর রচিত রামায়ণ বা ‘রামাবতারম’ রামায়ণের এক অন্য পাঠ। যেখানে কবি কম্বন তাঁর রসদ জোগাড় করছেন আদিকবি বাল্মীকির থেকেই, তবে রচনা করছেন নিজের কাব্যচেতনায়, নিজের সময়ের আলেখ্যে। যে সময়টায় ভক্তি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচেকানাচে, যখন দেবতা ও ভক্তের ব্যক্তিগত মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে। যেখানে দেবতা স্বয়ং মাটিতে নেমে আসছেন, ভক্তের দ্বারে উপবিষ্ট, ভক্তের দর্শনকাতর। এমন সময়ে কবি কম্বন লিখছেন রামের এমন এক দেবত্বের কাহিনি, যেখানে রাম আর কেবল মানুষ নন, দেবতা, এক ও একমাত্র ঈশ্বর, কিন্তু মানুষের স্পর্শ পেতে আকুল। যেখানে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনও মধ্যস্থতাকারী নেই। নেই কোনও মন্দির, পূজারি। রাম এখানে কবীরের, মীরাবাইয়ের, তুলসীদাসের। কবীরের কথায়– ‘থারো রাম হৃদয় মে, বাহার কিউ ভাড়কে?’
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার, বহু ধারায় খরস্রোতা বাংলায় রামায়ণ চর্চা
ভক্তি আন্দোলনের স্বভাব অনুযায়ী তাই কম্বন রামায়ণ হয়ে উঠল প্রেমের আখ্যান। যেখানে শুধু ভক্ত আর ভগবান নয়, রাম ও সীতারও প্রেম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। জনকের রাজসভায় প্রবেশ করার আগেই সীতা রামকে দেখতে ছুটে এলেন বারান্দায়, দেখলেন রামের কাঁধ, রামের পা, রামের হাত। চোখ সরাতে পারলেন না। এমন সুন্দর শরীর সীতা আগে দেখেনি। সীতার এই দৃষ্টি কি যৌনতার দৃষ্টি নয়? নয় কি এক ব্যক্তিগত মুহূর্তের? নিভৃত প্রাণের দেবতার?
তাই তো রাবণের সীতাকে হরণ করার নেপথ্যে কবি রচনা করেননি কোনও যুদ্ধোদ্যত রাবণকে। সূর্পণখার কাছে সীতার কথা শুনেই সে প্রেমে পড়ে যায় সীতার। সূর্পণখা যখন সীতার বিবরণ দিতে থাকে, রাবণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সে প্রেমে পড়ে স্বপ্নের মতো। এদিকে সূর্পণখাও রাক্ষস বংশের বা কুরূপা নয়, সেও এক সুন্দরী মেয়ে, যে লক্ষ্মণকে চেয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্মণ সেই প্রেম গ্রহণ না করে সূর্পণখার নাক কেটে দেয়। কবি কম্বন কিন্তু মনে রেখেছেন তাঁর এই কাব্য লেখার উদ্দেশ্য। তাই তিনি বারবার ফিরে যান প্রেমের কাব্যে। তাই যখন রাম শেষমেশ বধ করে রাবণকে, সেই আখ্যান উত্তীর্ণ হয় সফল ট্রাজেডিতে। যেখানে রাবণের বুক চিরে দেয় রামের তির। যে বুকে সীতাকে ধরেছিল রাবণ। তাই অশোকবনের থেকেও রাবণের মনে সীতার বন্দি হওয়া বিষয় হয়ে ওঠে এই কাব্যে। কবি কম্বন লিখছেন রাবণের বুক যখন এফোঁড়-ওফোঁড় করে তির ঢুকে যায়, তখন সীতা মুক্ত হয়।
কুম্ভকর্ণের চরিত্র অঙ্কনেও কম্বন এক অসহ বেদনা বুনে দেন। কুম্ভকর্ণ জানে রাবণের পক্ষে যুদ্ধ করা অন্যায়, সে কুরে কুরে মরতে থাকে আড়ালে। বিভীষণের রামের পক্ষে যাওয়াকে সমর্থন করে। বিভীষণকে বলতে থাকে, সে যেন নিজের অবস্থানে স্থির থাকে। কিন্তু তার পক্ষে রাবণকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয় কোনও এক অচেনা সম্বন্ধ থেকে। যুদ্ধের শেষে যখন রাম কুম্ভকর্ণকে মারতে আসে, সে রামের কাছে প্রার্থনা করে বিভীষণের জন্য, রাম যেন বিভীষণকে আগলে রাখে যুদ্ধক্ষেত্রে। কারণ কুম্ভকর্ণ জানে, রাবণের ক্রোধ এসে বিভীষণের ওপরেই পড়বে প্রথমে। তার শেষ কথা ছিল নিজের ভাইকে রক্ষার প্রার্থনা।
দক্ষিণ ভারতের এই রামায়ণ তাই একটি ব্যক্তিগত ঈশ্বরীতলার রূপকথা। যেখানে কোনও ধর্ম নেই, জাত নেই, কোনও ভেদাভেদ নেই, হিংসা নেই। নিষাদরাজ গুহ যখন রাম, লক্ষ্মণ ও সীতাকে নদী পারাপার করে দেয়, রাম গুহ-কে বলে, তোমার আর আমার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আবারও সেই ঈশ্বরের নেমে আসা, ভক্তের সঙ্গে মিশে যাওয়া। কম্বনের এই কাব্য এক কবির সঙ্গে ঈশ্বরের সংলাপ।
মনে রাখতে হবে, কম্বন রামায়ণে ‘উত্তরকাণ্ড’ নেই। অর্থাৎ সীতার অগ্নিপরীক্ষা বা সীতার বাল্মীকির আশ্রমে নির্বাসনও নেই। সীতা এখানে স্বাধীন এক মানুষ, যে রামকে চেয়েছিল যৌনভাবেও। যে নিজের ইচ্ছেতে বাঁচে। যাকে চরিত্রের পরীক্ষা দিতে হয়নি, যাকে নির্বাসনে যেতে হয়নি। সে সমাজের চোখে পতিত নয়, সে সমাজের দ্বারা চিত্রিত নয়।