মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র। বাংলার প্রদেশে প্রদেশে তিনি জড়িয়ে আছেন বহু রূপে, বহুত্বের স্বরূপে। তারই সন্ধানে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘রামচরিত’।
মহাকাব্যিক রামের নির্মাণই নৈতিকতার নিরিখে আদর্শপুরুষ হিসাবে। সে কাহিনির মূল কাঠামো এক রেখেও কৃত্তিবাস তাঁর রাম-আখ্যানে বুনে দিলেন নিজস্বতা। যে-নিজস্বতা বঙ্গের জল-হাওয়ায় পুষ্ট। রামপুজোর যে প্রচলন বাংলায় রয়েছে, রামের সেই মূর্তিও বাংলার নিজস্ব।
লিখছেন শুভদীপ রায়।
শ্রীরামচন্দ্র কে? তিনি ছিলেন ‘গণদেবতা’, হালে হয়েছেন ‘ভোটদেবতা’। তবে, নিশ্চিত করেই বলা যায়, রামচন্দ্র ভারতবাসীর প্রিয় চরিত্র, ফলত দেবতাও। ‘দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা’- এ দেশ তো চিরকাল এমন মন্ত্রেই বিশ্বাস করে এসেছে। রামচন্দ্রের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার, বহু ধারায় খরস্রোতা বাংলায় রামায়ণ চর্চা
শাস্ত্র বলে, রামচন্দ্র বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। সাত কাণ্ডে সেই ‘রামায়ণ’ রচনা করে গিয়েছেন বাল্মীকি। তা অবশ্য সংস্কৃতে। তারপর বিভিন্ন ভাষায় হয়েছে রামায়ণের অনুবাদ। তবে অনুবাদ মানেই যে হুবহু ভাষান্তর তা নয়। অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে প্রথমেই তেমনটা হয়নি। বাংলায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। নেহাত ভাষার তফাত নয়, কৃত্তিবাসের হাত ধরে বাঙালির বৈশিষ্টও আরোপিত হল রাম চরিত্রে। ‘শ্রীরাম পাঁচালী’-তে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, হনুমান সকলেই যেন বাল্মীকি রামায়ণ থেকে স্বতন্ত্র। রামের শৌর্য-বীর্য অক্ষুণ্ণ রেখেও, কাহিনির মূল কাঠামোয় তেমন হেরফের না-করেও কৃত্তিবাস তাঁর রাম-আখ্যানে বুনে দিলেন নিজস্বতা। যে-নিজস্বতা বঙ্গের জল-হাওয়ায় পুষ্ট। ফলে এখানে রাম যেমন যুদ্ধোদ্যত, তেমন বিলাপরত-ও। আসলে মহাকাব্যিক রামের নির্মাণই নৈতিকতার নিরিখে আদর্শপুরুষ হিসাবে। এত বড় বৈচিত্রের দেশে, প্রদেশ ভেদে যখন সেই রামচরিত্রের পর্যালোচনা এবং নতুন নির্মাণ শুরু হল, তখন এসে মিশে গেল আঞ্চলিক সংস্কৃতির পরতও। কৃত্তিবাস, আর্যপুরুষ রামের আধারেই নির্মাণ করেছিলেন বঙ্গজীবনের আদর্শপ্রতিমাও।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: শস্যের রূপকে রাম-সীতা ভাই-বোন, রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ মানুষের যন্ত্রণার কাব্য
কৃত্তিবাসের রামায়ণ কোনওভাবেই বাল্মীকির অনুকরণ নয়, অনুসরণ বলা যেতে পারে। মূল কাহিনিরেখা ধরে এগোলেও তিনি তাঁর কাব্য রচনায় অনেকটাই স্বাধীনতা নিয়েছেন। নিয়েছেন আর-এক সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষিতে রামকে প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায়েই। তাই তাঁর রামায়ণে স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে বাঙালি সমাজের ঘরোয়া আটপৌরে ছবিটি। মহাকাব্যের উচ্চতা ও ব্যাপ্তি, মহৎ চরিত্র ও ঘৃণ্য চরিত্রের দোটানা এবং দ্যোতনা পেরিয়ে তা যেন অনেকটাই লোকায়ত। কৃত্তিবাসের লক্ষ্মণ যেন তাঁর চেনা সমাজেরই কোনও অপরিণামদর্শী উদ্ধত যুবক। কৈকেয়ী-মন্থরা নীচ স্বার্থ-সন্ধানী, সেকালের বাংলার অন্দরমহলে যেমন নারীর দেখা মিলত ভূরি ভূরি। আবার কৃত্তিবাসের সীতা সর্বংসহা, কান্তকোমল। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলেন, সীতা যেন ‘শাশুড়ি-তর্জিতা ও ননদী-ভীতা বাঙালি গৃহবধূর মতো অস্থিহীন কোমল মূর্তি’। আবার রাম সম্পর্কে সীতার বর্ণনাতেও স্পষ্ট ফুটে ওঠে বঙ্গ গৃহবধূর ছাপ। মুনিপত্নীরা সীতাকে রামের পরিচয় যখন জিজ্ঞাসা করছেন, তখন কৃত্তিবাস লেখেন,
লাজে অধোমুখী সীতা না বলেন আর।
ইঙ্গিতে বুঝান স্বামী ইনি যে আমার।।
মানে স্বামীর নাম মুখেও আনবেন না সীতা। এ সংস্কৃতি বাঙালি গৃহবধূদের পরিচিত।
অন্যদিকে রাক্ষস রাবণ একেবারে বর্বর, দুর্বিনীত। অথচ তিনি রামের প্রচ্ছন্ন ভক্তও বটে। বীরবাহু-তরণীসেন, অহিরাবণ-মহীরাবণ- কেউ ভক্তিরসে, কেউ বীররসে, কেউ করুণরসে সিক্ত হয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতিকেই যেন স্বীকার করে নিয়েছে। লঙ্কাকাণ্ডেও একাধিক বাঙালি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন কৃত্তিবাস। রাক্ষসদের ‘বাটাভরা গুয়া’ অর্থাৎ পান-সুপারির লোভ দেখাচ্ছেন রাবণ। আবার গঙ্গা-অবতরণের সময় কৃত্তিবাস গঙ্গাতীরের যে সমস্ত তীর্থের নাম করেছেন তার অনেকগুলি পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। যেমন মেড়াতলা, নদিয়া, নবদ্বীপ, সপ্তগ্রাম, মাহেশ- এইসব স্থান নামের উল্লেখ কৃত্তিবাসী রামায়ণের ছত্রে ছত্রে মেলে।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: যুদ্ধের দিনে প্রেম… কম্বনের রামায়ণ যেন ব্যক্তিগত ঈশ্বরীতলার রূপকথা
বাঙালি বরাবরের ভোজনবিলাসী, তাই কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাঙালি খাবারের উল্লেখও কম নেই। যেমন ঋষি ভরদ্বাজ যখন বানরবাহিনীকে ভোজন আপ্যায়ন করাচ্ছেন, সেখানে মতিচুর, মোণ্ডা, রসকরা, মনোহরা, সরুচাকুলি, গুড়পিঠে, রুটি, লুচি, খুরসা, কচুরি, ক্ষীর, ক্ষীরদা, ক্ষীরনাড়ু, অমৃতি, চিতুইপুলি, নারিকেল পুলি, কলাবড়া, তালবড়া, ছানাবড়া, ছানাভাজা, খাজা, গজা, জিলাপি, সহ বিভিন্ন ধরনের পিঠের উল্লেখ মেলে। উত্তরকাণ্ডে স্বয়ং সীতাও নিজে হাতে রান্না করে লক্ষ্মণকে এইভাবে খাইয়েছিলেন। কবির বর্ণনায়,
প্রথমেতে শাক দিয়া ভোজন আরম্ভ।
তাহার পরে সুপ আদি দিলেন সানন্দ।।
ভাজা ঝোল আদি করি পঞ্চাশ ব্যঞ্জন।
ক্রমে ক্রমে সবাকার কৈল বিতরণ।।
শেষে অম্বলাম্ভ হলে ব্যঞ্জন সমাপ্ত।
দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত।।
বলাই বাহুল্য, এ ভোজনতালিকা অযোধ্যা-মিথিলার নয়, একেবারে বাংলার রান্নাঘরের বাঙালির খাদ্যতালিকা।
অর্থাৎ বাঙালির যাপনের স্বকীয়তাকে স্বীকার করে নিয়েই কৃত্তিবাস রামের আদর্শকে বসাতে চাইলেন বাঙালি জীবনের অক্ষে। এতে রামও হয়ে উঠলেন বাঙালি-ই।
বাংলায় রামপুজোর প্রচলনও আজকের নয়। কৃত্তিবাসের রচনায় যেমন রামের এক অন্য রূপ আমরা দেখতে পাই, তেমনই হাওড়ার রামরাজাতলা-তেও বাংলার নিজস্ব এক রাম বছরের পর বছর ধরে পূজিত হয়ে আসছেন। তাঁর মূর্তি উত্তর ভারতের রামের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। গায়ের রং নীল নয়, সবুজ। রয়েছে পুরুষ্টু গোঁফও। যদিও সেই রামচন্দ্রের জীবনকাহিনি হুবহু কৃত্তিবাসের রামের মতোই কি না, তা তর্কের বিষয়। কারণ কৃত্তিবাস যেভাবে রামের বর্ণনা করেছেন, সেই অনুযায়ী মূর্তি গড়লে তাঁকে নিতান্তই বাঙালি যুবক মনে হতে বাধ্য।
একেবারে রামের জন্মের সময় থেকেই শুরু করা যাক। সেখানেও বাঙালি আচার আচরণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন কবি। রামের জন্মের পর পাঁচদিন ‘পাঁচুটি’, ছ-দিনে যষ্ঠীপুজা, আট দিনে ‘অষ্টকলাই’, তেরো দিনে অশৌচান্ত, ছ-মাসে অন্নপ্রাশন ইত্যাদি সবই রয়েছে কৃত্তিবাসের রামায়ণে। আর পাঁচজন বাঙালি যুবকের মতো তিনিও দুঃখে কাঁদেন, ভেঙে পড়েন, বিলাপ করেন। সংস্কৃত কাব্যের সংযত নায়কের মতো আবেগকে বেঁধে রাখেন না কৃত্তিবাসের রাম। প্রেমে-করুণায় সিঞ্চিত বাংলার সজলতা দিয়েই যেন তাঁকে গড়েছেন কৃত্তিবাস। বলা যায়, উত্তর ভারতীয় রাম-নির্মাণের এক প্রতিবয়ানই রচনা করলেন কৃত্তিবাস।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: রায়সাহেবের রামদর্শন– থাকেন ‘জটায়ু’, দুষ্টু লোকের পাশেই চলে রামের ভজন
রামের চরিত্র বিশ্লেষণেও তাই ধরা পড়েছে বাঙালিয়ানা। কৃত্তিবাসের রামকেও বাঙালিসমাজ ঈশ্বরজ্ঞানেই ভক্তি নিবেদন করেছেন। আর রামচন্দ্রের জীবনের ট্র্যাজিক পরিণামকে দৈবলীলা মনে করেছেন। অর্থাৎ বাল্মীকির রামায়ণে যেভাবে বীররস প্রাধান্য পেয়েছে, কৃত্তিবাসী রামায়ণে সেইভাবেই ফুটে উঠেছে করুণরস। তা সে দশরথের দেহত্যাগ হোক বা সীতার পাতাল প্রবেশ। রামচন্দ্র প্রতিবারই বিষণ্ণ, বিলাপরত। তিনি বীর এই নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু ‘পুরষ কাঁদতে জানে না’, এ তত্ত্ব কৃত্তিবাসের রামের ক্ষেত্রে খাটে না। রাজধর্মের দোহাই দিয়ে সীতাকে নিঃসংকোচে পাতালপ্রবেশের নির্দেশ দিচ্ছেন যে রাম, কৃত্তিবাসের রামায়ণে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার এক্ষেত্রে সীতার আচরণেও বেশ পার্থক্য চোখে পড়ে। যেমন বাল্মীকি রামায়ণে রামচন্দ্র স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে, সীতা, সতীত্বের গৌরবে এবং পিতৃকুলের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে রামকে জবাব দিয়েছেন। একই পরিস্থিতিতে কৃত্তিবাসের সীতা বলছেন:
সবে মাত্র ছুঁইয়াছে পাপিষ্ঠ রাবণ।
ইতর নারীর মত ভাব কি কারণ।।
অর্থাৎ, বাঙালি ঘরে যে পতিব্রতা সতীর আদর্শ প্রচলিত, অপমানের উত্তরে যে নারীর সম্বল কেবল চোখের জল, কৃত্তিবাসের সীতাও সেই ছাঁচেই ঢালা।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: বাংলার আছে নিজস্ব ‘অযোধ্যা’, এখনও বইছে ক্ষীণস্রোতা ‘সরযূ’
কেবল কান্না নয়, হাসিতেও কৃত্তিবাস পুরোদস্তুর বাঙালি। ব্যঙ্গবিদ্রুপের বেলাতেও বাঙালির স্বভাবটিই তাঁর চরিত্রদের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছেন কবি। হনুমান তো একেবারে বাসরঘরের রসিকতাকে দিব্য আয়ত্ত করেছেন। সুন্দরকাণ্ডে সে বর্ণনা মেলে। সেখানে রাবণের অনুচরেরা হনুমানকে বেঁধে আনার সময় রসিকতা জুড়েছে রাক্ষসীরা। হনুমানের সরস উত্তর, রাবণ নাকি তাঁকে জামাই করবার জন্য বেঁধে এনেছেন। আর কৃত্তিবাসের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে, নতুন জামাইয়ের মতোই শ্যালিকাদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন হনুমান-
প্রমীলা শালাজ পাব পরমারূপসী।
রসরঙ্গে তার সঙ্গে রব দিবানিশি।।
কতগুলি শালী পাব লঙ্কার ভিতর।
ইহা জানিলেই মোর জুড়ায় অন্তর।।
আবার লঙ্কাকাণ্ডে রামচন্দ্র অঙ্গদকে বলছেন,
হে অঙ্গদ মহাবলী:
রাবণ রাজারে কিছু দিয়া এস গালি।।
রামের নির্দেশমতো অঙ্গদ রাবণের রাজসভায় গিয়ে প্রাকৃত ভাষায় রাবণকে চমৎকার গালাগালি করলেন।
এই যে গালাগালি দেওয়া এ-ও তো বাঙালির চরিত্রবৈশিষ্ট্যই হয়ে উঠেছিল। মনে রাখতে হবে, পঞ্চদশ শতকে কৃত্তিবাস যখন ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ রচনা করছেন, তার আগেই তুর্কি আক্রমণে রাতারাতি বাংলার গদি উলটে গিয়েছে। সপ্তদশ অশ্বারোহীর অতর্কিত হানার মুখে রুখে দাঁড়ানো দূরে থাক, নিতান্ত কাপুরুষের মতোই পালিয়ে গিয়েছেন রাজা লক্ষ্মণ সেন। আর নিজের ঘরে দুয়ার এঁটে বাঙালি মেনে নিচ্ছে ভিনদেশের ভিনধর্মের শাসকদের এই আকস্মিক রাজা হয়ে বসাকে। ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো বাঙালির শক্তি হাতের জায়গায় নেহাতই মুখে এসে ঠেকেছিল। আগ্রাসনের প্রতিরোধ তার সাধ্যের অতীত, তবু মুখেন মারিতং জগৎ। সেই অভিজ্ঞতারই আভাস যেন থেকে গেল কৃত্তিবাসের কাব্যেও। রামচন্দ্রের জয়গাথার মধ্যে বাঙালির হেরে যাওয়ার যন্ত্রণাকেও হয়তো মিশিয়ে দিলেন বাঙালি কবি। আর সময়ের বেদনাকে ধারণ করেই বাঙালি হয়ে উঠলেন বাল্মীকির রাম।