বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো শুরু করতে গিয়ে বলি দিতে চেয়েছিলেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। তবে, মা সারদার নির্দেশ শিরোধার্য করে সে পথে আর এগোননি। শক্তিসাধনায় বলিপ্রথার রেওয়াজ ছিল বহুদিনের। কিন্তু কী এই বলির মূল উদ্দেশ্য? নেহাত প্রাণীহত্যা, নাকি অন্য কিছু? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
প্রাণীহত্যা করে ঈশ্বরের আরাধনা করা কি কাম্য? এ প্রশ্ন অমূলক নয়। তাই শক্তিসাধনায় বলিপ্রথাকে অনেকাংশেই ত্যাগ করা হয়েছে। বর্তমানে তা প্রতীকী ভাবেই পালন করা হয়ে থাকে। তবে, এ-কথা অনস্বীকার্য যে বলি দেওয়ার প্রথা শক্তিপুজোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবেই জড়িত। তার নানা তাৎপর্যও আছে।
আরও শুনুন: দেবী কালিকার নিত্যসঙ্গী শৃগাল… দেবীর ভৈরবের রূপান্তর, নাকি স্বয়ং ভৈরব?
শাস্ত্রমতে, মা কালী তথা দেবী চণ্ডিকাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলিদান অবশ্য কর্তব্য। তবে যে কোনও প্রাণী বলি হিসেবে উৎসর্গ করা যায় না। শাস্ত্র অনুযায়ী, যে বিশেষ ৮ ধরনের বলিতে দেবীকে প্রসন্ন করা যেতে পারে, সেগুলি হল- ১) পাখি, ২) কচ্ছপ, ৩) কুমির, ৪) মৃগ বা হরিণ গোত্রীয় শূকর, ছাগল, মহিষ, গাধা, খড়গোশ জাতীয় প্রাণী ৫) সিংহ, এবং ৬) মাছ। আর সপ্তম হল, পূজারি বা উপাসকের নিজের শরীরের রক্ত। আর এসবের অভাবে কোনও হাতি বলি দিলেও দেবী অত্যন্ত প্রীত হন বলে জানা যায়। এই আটপ্রকার বলিযোগ্য প্রাণীর মধ্যে মানুষের রুধির দেবীর সবচেয়ে প্রিয়। তাই এই বলিকে বলা হয় অতিবলি। কুমির, কচ্ছপ প্রভৃতি উভচর প্রাণীর বলিকে বলা হয় মহাবলি। এ ছাড়া আর সবই সাধারণ বলির মধ্যে পড়ে। সাধক তাঁর ইচ্ছা বা সামর্থ অনুযায়ী, এর মধ্যে যে কোনোটি উৎসর্গ করতে পারেন দেবীর উদ্দেশে। তবে সেই প্রাণীর গুণমানের উপর বা বলির ধরনের উপর নির্ভর করবে দেবী ঠিক কতটা সন্তুষ্ট হবেন। এবং সাধক তার প্রেক্ষিতে কী ফল পেতে পারেন।
আরও শুনুন: কলকাতা জুড়ে ছড়ানো কালীক্ষেত্র, কেমন ছিল পুরনো কলকাতার কালী আরাধনা?
তাও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে ছাগবলি দেওয়া হয়, তার একটা কারণ হতে পারে এই যে, যে প্রাণীর মাংস ভক্তের বিশেষ পছন্দের, অন্যথায় যে বস্তু ভক্তের বিশেষ পছন্দের, ভক্তিভরে তা-ই উপাস্য দেব-দেবীকে নিবেদন করার কথা বলা আছে শাস্ত্রে। আবার বলি হিসেবে শুধু পুরুষ প্রাণীদেরই উতসর্গ করার নিয়ম। দেবী কালির আরাধনা শক্তির আরাধনা। আর শক্তির অর্ধাংঙ্গ, শিব। স্ত্রীজীব আঘাত শিব-আজ্ঞা বিরুদ্ধ। তাই তা বলি দিতে নেই। অর্থাৎ পাখি অর্থে রাজহংসি এনে বলি দিলে কিন্তু একেবারেই অভীষ্ট পূরণ হবে না। আবার কোথাও তন্ত্রমতে দেবীর পুজোর সময়, যেসব প্রাণী ডিম পাড়ে, স্তন্যপায়ী এবং জলচর প্রাণীদের, স্ত্রী-প্রাণীর বলি দেওয়া যায়। দেবীকে মাছ নিবেদনের ক্ষেত্রে, প্রধানত শোল, বোয়াল ও রুইমাছ দেওয়ারই নিয়ম আছে শাস্ত্রে। অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে, মাছে যত কাঁটা কম হবে ততই তা নিবেদনের উপযুক্ত। বলির প্রাণীকে তিলক চন্দন ও ফুল নিবেদন করে, বিশেষ কিছু মন্ত্রোচ্চারণের নিয়ম আছে। যার সারার্থ হল, – তুমি শ্রেষ্ঠ জীব, আমার ভাগ্যে বলিরূপে উপস্থিত হয়েছ। তুমি চণ্ডিকাকে সন্তুষ্ট করে বলিদাতাকে সঙ্কটমুক্ত করো। স্বয়ং ব্রক্ষ্মা, যজ্ঞের প্রয়োজনে সব ধরনের বলির সৃষ্টি করেছেন। যজ্ঞের জন্যই আমি তোমায় বধ করছি। এই পশুবধ তাই হিংসা নয়। আর এরপরই খড়্গ নেমে আসে বধ্য প্রাণীটির ওপর। শাস্ত্র অনুযায়ী এই খড়্গই দেবী কালীর লোলজিহ্বা স্বরূপ। যা দেবীর রসনাতৃপ্তি ঘটায়।
আরও শুনুন: বিপ্লবী বাঘা যতীন থেকে রঘু ডাকাত, কীভাবে কালী হয়ে উঠলেন সকলের ‘মা’?
তবে, এই বলিপ্রথা বন্ধ করেছিলেন মা সারদা। দুর্গাপুজোর সময় এই বলির অনুরোধ নিয়ে যখন স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কাছে গিয়েছিলেন, তিনি তাতে রাজি হননি। সন্ন্যাসী হিসাবে সর্বভূতে অভয়দানই তাঁর কর্তব্য। অতএব কোনও প্রাণীহত্যারই প্রয়োজন নেই। স্বামীজি শাস্ত্রের উল্লেখ মেনেই এই বলির প্রস্তাব করেছিলেন। অর্থাৎ শাস্ত্রে যে বলির ইঙ্গিত আছে, তা অনস্বীকার্য। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলেন, বলি অর্থে শুধু প্রাণীহত্যার কথা বলে না আমাদের শাস্ত্র। পশুপ্রবৃত্তির বলিদানই এই প্রথার মূল বক্তব্য। এক একটি প্রাণীর সঙ্গে তাই আমাদের ষড় রিপুর প্রত্যেকটির তুলনা করা হয়। যেমন, কাম অর্থে ছাগ, ক্রোধ অর্থে মহিষ, মোহ অর্থে হংস ইত্যাদি। অনেকেই তাই বলেন, আসলে প্রাণীর নামের অন্তরালে আমাদের রিপুর উল্লেখ করে তা জয় করারই নির্দেশ দিচ্ছে শাস্ত্র। বর্তমানে, প্রাণীবলি হয় না। তবে, বলির যে মূল তাৎপর্য অর্থাৎ রিপুদমন তা শক্তিসাধনার অঙ্গ আজও। এমনকী দেশের জন্য যখন প্রাণ বলি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন দেশের বীর সন্তানরা, তখনও তাঁরা শক্তির সাধনাই করেছিলেন। বলা যায়, সময়ের প্রেক্ষিতে শক্তির সঙ্গে বলি নানা অর্থ এবং তাৎপর্য নিয়েই প্রতিভাত হয়েছে।