লটারি এসে ভাগ্য বদলে দিয়েছিল কলকাতার। রাস্তাঘাট থেকে পুকুর, এমনকি টাউন হল- কলকাতা শহরের বহু বিশিষ্ট জিনিসের নেপথ্যেই আছে লটারি থেকে পাওয়া অর্থ। কীভাবে কলকাতা হয়ে উঠল লটারির শহর? জানাচ্ছেন, সুশোভন প্রামাণিক।
লটারি মানেই কারও না কারও প্রাপ্তিযোগ। প্রাপ্তিযোগ তেমন হলে ভাগ্যও বদলায়। কিন্তু একটা গোটা শহরের ভাগ্য বদলে দেবে লটারি, তাও কি সম্ভব? কলকাতা শহরের ইতিহাস বলছে, আলবাত সম্ভব। এই শহরের গড়ে ওঠার অনেকটাই যে লটারির টাকায় সে কথা আর অস্বীকার করার উপায় কোথায়!
রাস্তার কথাই ধরা যাক। ওয়েলেসলি স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট বা কর্নওয়ালিস স্ট্রিট- কলকাতা শহরের এইসব রাস্তা দিয়ে কত কত বার না গেছেন। কখনও আবার হেঁটে বেড়িয়েছেন কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের গন্ধ মেখে। কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে সাহেবিয়ানার নস্টালজিয়ায় বুঁদ হতে ঢুঁ দিয়েছেন পার্ক স্ট্রিটের আশেপাশে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কিড স্ট্রিট, হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিট, লাউডন স্ট্রিট, রডন স্ট্রিট নিয়েও নিশ্চয়ই জমে আছে অনেক স্মৃতি। অথবা বাবুঘাট বা অধুনা স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোড বা স্ট্র্যান্ড রোড – সে-ও তো আপনার খুবই চেনা। এই সব রাস্তা গড়ে উঠেছিল বা কোনও কোনও রাস্তার সংস্কার হয়েছিল লটারির টাকাতেই।
আরও শুনুন : ‘১০০০বছরের পুরনো ডিম’ রবীন্দ্রনাথের পাতে, তারপর…
জানতে ইচ্ছে করে, কেন লটারির টাকায় গড়ে তোলা হয়েছিল শহরের রাস্তাঘাট? তাহলে একটু পিছন ফিরে তাকাতে হয়। জানা যাচ্ছে, শুরুর দিকে কলকাতায় সুগম রাস্তা ছিল হাতে গোনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি সনদ পেয়ে নজর দেয় কলকাতার দিকে। বছর আটেকের মধ্যেই কলকাতা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী। এখন, রাজধানীর হালচাল তো রাজকীয় হতেই হবে। তাই রাস্তার সংস্কার, রাস্তা নির্মাণ, পানীয় জলের জন্য পুকুর খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এত টাকা আসবে কোথা থেকে?
কোম্পানির কর্তাব্যাক্তিরা অনেক ভেবে ঠিক করলেন, লটারিই হবে মোক্ষম উপায়। অতএব লাগ লটারি কলকাতার কপালে। ইংল্যান্ডে অনেকদিন ধরেই লটারি ছিল খুব জনপ্রিয়। ঠিক হল সেই আদলে কলকাতাতেও হবে লটারির খেলা। ১৭৮৮ নাগাদ তৎকালীন ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রথম ডাকা হল একটি বড় লটারির খেলা। পুরস্কার ছিল এখনকার চিনে ব্রেকফাস্টের হটস্পট টেরিটি বাজার। এদুয়ার্দো তিরেত্তা-র মালিকানার এই বাজারের লটারিপ্রাপ্তি হয়েছিল চার্লস ওয়েস্টন নামের এক ব্যাক্তির।
রাজধানী হওয়ার সুবাদে ক্রমশ জনসংখ্যা বাড়ছিল কলকাতায়। বাড়ছিল পানীয় জলের সমস্যা। স্থানীয় বাসিন্দাদের জলসঙ্কট মেটাতে লটারি কমিটি সেই সময় শহরে চারটি বড় পুকুর কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই তালিকায় ছিল ওয়েলেসলি স্কোয়ার, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, কলেজ স্কোয়ারও৷
আরও শুনুন : বাঙালির নাকি মাছ খাওয়া বারণ! কী বলছে পুরাণ?
শহরে তখন সাহেবদের আনাগোনা বেশ বাড়ছে। দশজন লোক মিলে একটু আলাপ-আলোচনা-অনুষ্ঠান-খানাপিনা হবে- এমন একটা যুতসই হলের খুব অভাব কলকাতায়। ঠিক হল নির্মিত হবে টাউন হল। কিন্তু এই বিপুল কর্মযজ্ঞের জন্য এত টাকা আসবে কোথা থেকে? স্রেফ অনুদানের অর্থে এই বিপুল ব্যয় বহন তো অসম্ভব। তাহলে উপায়! এখানেও খেল দেখাল সেই লটারি।
একদিন হইহই করে শুরু হয়ে গেল লটারির টিকিট বিক্কিরি। এক একটা টিকিটের দাম ষাট সিক্কা। অঙ্কটা কেমন? তার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে সেকালের কেরানির বেতনের হিসেব জানলেই, বাবুরা বেতন পেতেন দুই সিক্কা। এদিকে, প্রথম লটারির সাড়ে ছয় হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে গেল চোখের নিমেষেই। কিন্তু ওইটুকুতে থামলে হবে কেন! অতএব আবার ঘোষণা, আবার টিকিট বিক্রি। ব্যাপারটা চলতেই থাকল। পরপর চারবার হল লটারি। সেই লটারির ব্যাঙ্কার ছিল দেশের প্রথম ব্যাংক, ‘ব্যাংক অফ ক্যালকাটা’। লটারির কমিশনার ছিলেন জর্জ ডাউডসওয়েল। প্রায় পনেরো বছরের অর্থ সঞ্চিত করে গড়ে তোলা হয়েছিল সেকালের টাউন হল। খরচ হয়েছিল কত জানেন? সাত লক্ষ সিক্কা। হিসেব মতো তাজমহল নির্মাণের খরচের প্রায় কাছাকাছি।
লটারি খেলা, টিকিট বিক্রি, সেই টাকায় শহর সংস্কার থেকে টাউন হল নির্মাণ সবই তো দিব্যি হল। জানা যায়, ১৮০৯-১৭ পরপর আট বছর ধরে সতেরোটি লটারির খেলায় প্রাপ্ত অর্থের অন্তত বারো লক্ষ টাকা এই শহরের উন্নতিকল্পে ব্যবহার হয়।কিন্তু যে মোক্ষম প্রশ্ন মনে আসে, এত বছর ধরে চলা লটারির টিকিট এত দাম দিয়ে কিনতেন কারা? সবই নিশ্চয় সাহেবরা কিনতেন না। উত্তর হল, কিনতেন সেকালের হঠাৎ বাবু, ব্ল্যাক জমিন্দাররা। অনেকেই সম্মান রক্ষার খাতিরে, অনেকেই স্রেফ খেয়ালে, অনেকেই টাকা ওড়ানোর অছিলায়। আর কিনতেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। তাঁদের আশা ছিল যদি একটা হঠাৎ প্রাপ্তিযোগে তাঁদের ভাগ্য বদল ঘটে।
এরকম বহু লটারির খেলা দেখেছে শহর কলকেতা। লটারি কমিটির অনুকরণে অনেক বিত্তবান খেয়ালি বাবু নিজের সর্বস্ব বাজি রেখে নিজের উদ্যোগে লটারির আয়োজন করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, এমন উদাহরণও অনেক আছে।
আরও শুনুন : jalebi: জিলিপি নাকি ভিনদেশি? অমৃতির বাড়িই বা কোথায়!
সরকারি নির্দেশে একসময়, লটারি কমিটির বিলোপ ঘটে। কেন কমিটি তুলে দেওয়া হয়েছিল, বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন গোটা ব্যাপারটার মধ্যে এমন উন্মাদনা দেখা দিচ্ছিল যা আসলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কারওর মতে শেষের দিকে লোকসানও হচ্ছিল। আবার অনেকের ধারণা, কমিটির অনেকে পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার জন্য দুর্নীতিও করছিলেন।
লটারি কমিটি উঠে যাওয়ার কারণ যাই হোক, লটারির কল্যাণেই, এই শহরের চেহারার যে আমূল বদল এসেছিল, তার সাক্ষী তো আমরা সকলেই। আর সেই জন্যই কলকাতাকে আজও অনেকে বলে থাকেন- লটারির শহর।